স্লামালেকুম। আসতে পারি?
রিসিপশনে বসা অনুর্ধ পঁচিশ বছরের রমনী আহ্বান জানায়,'হাঁ আসুন'।
আমীর উদ্দিন তার কাছে গিয়ে দাড়ায়।তিনি আসার হেতু জানতে চান। কন্ঠে বলে'পত্রিকায় আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি'। তার জড়তা কাটতে চায়না।
ও হ্যাঁ,এটা শিক্ষিত বেকারদের জন্য আমাদের একটি স্পেশাল কোর্স; তিনমাসের কোর্স। প্রশিক্ষণ দেয়া হবে পাশাপাশি থাকা খাওয়ার জন্য প্রথম মাসে ২০০০,দ্বিতীয় মাসে ৩০০০,তৃতীয় মাসে ৪০০০ টাকা করে দেয়া হবে। পরবর্তীতে চাকুরী হয়ে গেলে মাসে ৫০০০ টাকা সেলারি পাবেন। এক কাজ করুন ২০০ টাকা আর এককপি ছবি দেন,আমি একটা ফরম দিচ্ছি;এখানে একটা স্বাক্ষর করেন। এক ঘন্টা পরে এসে খোঁজ নিবেন।
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে আমীর উদ্দিন,চাকুরী তাহলে একটা জুটে গেল! ছবি , টাকা আর একটা ফরমে সই দিয়ে বেরিয়ে আসে।
কারওয়ান বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে সোনারগাও হোটেলের সামনে এসে দাড়ায়। নিবিষ্ট চিত্তে খুটিয়ে দেখতে থাকে বিল্ডিংটাকে। সে শুনেছে এখানে খেতে গেলে অনেক টাকা বিল দেয়া লাগে। ভাবে চাকুরীটা হয়ে গেলে এদিন এই হোটেলে এসে....। পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে হেটে এফডিসির সামনে আসে।অনেক লোকের জটলা দেখে সেও দাড়ায়।কতক্ষণ পর পর গাড়ি ভিতরে যায় আবার বের হয়।বেশিরভাগ গাড়িই কাল গ্লাসের; ভেতরে কিছুই দেখা যায়না।
পেছনে সরানোর উসিলায় আচমকা এক লোক তাকে সম্মুখ দিক থেকে ধাক্কা দেয়।সময় পেরিযে যাচ্ছে ভেবে আর দাড়ায়না। কারওয়ান বাজারে চলে আসে। এখানে এসে জানতে পারে তার চাকুরী হবে,ভর্তি ফি বাবদ তিন হাজার টাকা দিতে হবে।
মাত্র কয়েশ টাকা আছে তার কাছে।বিনীত কন্ঠে শূধায়'আমার কাছে টাকা নেই,আপনারা প্রশিক্ষণ ভাতা বাবদ যে টাকা দেবেন তার থেকে যদি....।'এটা আমাদের ফি প্রশিক্ষণে যা পাবেন তার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক আছে ,আপনি বাড়ি চলে যান , যেদিন টাকা নিয়ে আসবেন সেদিনই আপনাকে নিয়োগ দিয়ে দিব।
আমীরউদ্দিন বেরিয়ে আসে। ফরম বাবদ যে টাকাটা দিয়েছিল তা ফেরত চাওয়ার ভাষা তার মুখ দিয়ে বের হয়নি। একটি রেস্টুরেন্টএ গিয়ে কিছু খেয়ে বিল দেবার সময় দেখে বুক পকেটে থাকা টাকা গুলো নেই! বুঝতে বাকী থাকেনা এফডিসির সামনের ধাক্কাটা টাকা নেওয়ার মূল হোতা।
ইস্কাটন রোডে আসে। অনেক খুজেঁ একটি ঔষধ কোম্পানীর অফিস বের করে সেখানে গিয়ে দেখে ১০০ টাকা দিয়ে নাম নিবন্ধন করতে হবে।দুটি প্রতিষ্ঠানকে একই মনে করে বাড়ি চলে আসে।
আমীর উদ্দিন বিএ পাশ করেছে দুই বছর হতে চলল। নিম্মবিত্ত পরিবারের ছেলে সে। বাবার নিজের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে।অনেক কষ্ট হয়েছে তাকে পড়াতে। তার জন্য ছোট বোনটাকে বেশি পড়াতে পারেনি। অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হয়েছে।
চাকুরীর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে আমীর উদ্দিন। নিয়মিত পত্রিকা পড়তে পারেনা। শুক্রবারে কেবল পত্রিকা রাখে। মাঝে মাঝে কলেজে একপাক ঘুরে আসে কেবল পত্রিকায় নতুন কোন চাকুরীর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে কিনা দেখার জন্য। প্রায়ই আশাহত হয়ে ফিরতে হয়,আবার কোন দিন কলেজে গিয়ে দেখে বিজ্ঞপ্তির অংশটুকু কে বা কারা কেটে নিয়ে গেছে।
চাকুরী দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন ভিন্নতা দেখেনা সে। সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন জমা নেয়ার আগেই কিছু টাকা নিয়ে নেয় আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নেয় ভিন্ন ছলে। কোনটার প্রতিই তার আস্থা নেই।তবু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখলে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে। তার যে একটা চাকুরী দরকার।
একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিতে যায়।প্রবেশপত্রে সেদিনই ফলাফল দেয়ার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে জানাবে বলে নোটিশ দিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন কোন পত্রের দেখা মেলেনা।
ছয় মাস পর ভাইভা পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এবার হয়তোবা তার চাকুরীটা হয়ে যাবে ভরসায় ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে গিয়ে দেখে যারা রিটেন পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের সবাইকেই ডেকেছে। এ প্রহসনের মানে সে বুঝেনা।সরকারী চাকুরীর প্রতি আস্হা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।
নতুন একটি ঔষধ কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী হয়ে একদিন আবেদন নিয়ে হাজির হয় নোয়াখালী। ট্রেন থেকে নামার সময় ঘটে এক ভয়ানক কান্ড। টিউশনির দেড়শ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। সাথে পকেট কোনে আরো দুই টাকা। ত্রিশ টাকায় টিকেট কাটে। নোয়াখালী স্টেশনে গাড়ী থামার পর দেখে ফ্লাটফর্মের দিকের দরজাটা বন্ধ।বার কয়েক চেষ্টা করে খুলতে না পেরে পরের কামরা দিয়ে নামার জন্য পা বাড়ায়। যেই নামতে যাবে, মোবাইল কোর্টের লোকজন তাকে আটক করে। প্রথম শ্রেনীতে উঠার দায়ে ১২০ টাকা আদায় করে নেয়। হতভম্ব হয়ে স্টেশন ত্যাগ করে অনেক খোঁজাখুজি করে কাঙ্খিত ঠিকানায় গিয়ে দেখে তা বন্ধ। সেদিন রোজা শেষে দুই টাকার মুড়ি কিনে ইফতারী করে যখন বাড়ি ফিরে রাত অনেক হয়ে যায়।
একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। ফের আবেদন করে। অনেক দিন পার হয় ইন্টারভিউ কার্ড আসেনা। আসেনা তো আসেনা।এরি মাঝে আরেকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে। লোক মুখে শুনেছে এই চাকুরী পেতে হলে বড় অংকের টাকা দিতে হবে। টাকা দেয়ার সামর্থ্য তার বাবার নেই। তবু আশায় থাকে।
গ্রামের রাস্তায় বের হলে লোকজন নানা বিরক্তিকর মন্তব্য করে।"দেখ ছেলেটা কত লেখা পড়া করেছে,চাকুরী নাই;আরে এ দেশে মামা দুলাভাই না থাকলে কি আর চাকুরী মেলে? এখন ঘুর। না হালের হয়েছে না হয়েছে জোয়ালের। বাপটা খেটে মরছে উনি নবাবজাদা হয়ে ঘুরে বেড়ান।" এসব শুনতে আর ভাল লাগেনা তাই বাড়ি থেকে বের হওয়া অনেকটা বন্ধ করে দেয়।
একদিন পত্রিকার পাতায় একটি খরব দেখে চোখ আটকে যায় আমীর উদ্দিনের। একটি বেসরকারী ফাউন্ডেশন এইচ এস সি পাশ থেকে শুরু করে এম এ পাশ বেকারদের জন্য বিশেষ এক কর্মসূচী হাতে নিয়েছ। তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করার পাশাপাশি পড়াশোনাও করা যাবে। তাদের পলিসি দেখে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে।
তিনটা ইন্টারভিউ কার্ড একসাথে আসে। বুধবার দিন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাতকার;বৃহস্পতিবার দীর্ঘদিন পূর্বে আবেদন করা প্রতিষ্ঠানের ইন্টারভিউ চট্টগামে আর শুক্রবারে অন্যটার পরীক্ষা কুমিল্লায়। নিজের টিউশনির কিছু টাকা এবং মায়ের কাছ থেকে কিছু নিয়ে রওয়ানা দেয়।
ঢাকায় সাক্ষাতকারের সময় ৪ টা এক ঘন্টা পূর্বেই সেখানে পৌছে। প্রতীক্ষার শেষ হয় সন্ধে সাতটায়। ফাউন্ডেশন প্রধান নাকি অন্য একটি মিটিংয়ে ছিলেন।আমীর উদ্দিনের সাক্ষাতকার শেষে তারা গ্রিন সিগনাল দিয়ে চলে যেতে বলেন। রাতের ট্রেনে চট্ট্রগ্রাম রওয়ানা দেয়।সারারাত না ঘুমিয়ে গাধাগাধি করে বসে থেকে সকালে পৌছে। অচেনা জায়গা চিনতে অনেক কষ্ট হয়। পকেটে অর্থের অভাবে পা দু’টোকেই বাহন বানিয়ে পথ খুঁজতে হয়। দুই ঘন্টা দেরিতে শুরু হওয়া পরীক্ষা শেষ হয় বিকেল ৪ টায়। ফেরত ট্রেন ধরতে হেঁটে পাহাড়তলী আসে। ট্রেন এখানে থামেনা শুনে আবার হেঁটে র্ওয়না দেয় বটতলী স্টেশনে।
রাত আটটায় একপ্রকার যুদ্ধকরে মেইল ট্রেনে উঠে। জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় এখানে।কিছু দালাল গোছের লোক আগেই ট্রেনে উঠে সিট দখল করে বসে আছে।যাত্রীদের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে। পুলিশও কম যায়না। তার ও টাকার বিনিময়ে একটি বগিতে লোক তুলছে। দুই দিনের কর্মক্লাতিতে ট্রেনে উঠার পরই ঘুমে চোখ বুঝে আসে। কিন্তু ঘুমাতে পারেনা যদি ট্রেন কুমিল্লা ছেড়ে চলে যায়। রাত একটায় ট্রেন থেকে নামে। চোখের পাশাপাশি শরীরেও ক্লান্তি ঝেঁকে বসে। একটি বিশ্রাম কক্ষে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুম দিতেই এক পুলিশ ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। বসার সিটটাও হারায়।
ভারসাসম্যহীন শরীরে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে রাতাটা কাটিয়ে সকালে বৃষ্টিতে কাকা ভেজা হয়ে এক স্কুলে হাজির হয়। তার মত হাজার হাজার চাকুরী প্রার্থী পূর্বেই এসে বসে আছে। মাত্র কয়েকটা পোস্টের জন্য এত প্রার্থী!কার হবে চাকুরী ভেবে পায়না। পরীক্ষা শেষে বাড়ী চলে আসে।
আমীর উদ্দিন মনে মনে আশাবাদী হয়ে উঠে,এবার নিশ্চয় একটা চাকুরী হবে। আশাটাকে একধাপ এগিয়ে দিতে সেই বেসরকারী ফাউন্ডেশন থেকে চিঠি আসে। সেখানে উল্লেখ আছে সে নিবর্বাচিত হয়েছে। সকল মূল সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে বলেছে তারা।
সেদিন শুক্রবার। সকালে কাঙ্খিত ঠিকানায় হাজির হয় ।পাঁচজন মানুষ তাকে নানা প্রশ্ন করে। শেষে তারা নিশ্চিত ভাবে জানায় সে নির্বাচিত হয়েছে। চাকুরী করবে পাশাপাশি এম বিএ পড়বে। বেতন হিসেবে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হবে। সেখান থেকে পড়াশোনার ফি হিসেবে আড়াইহাজার টাকা কেটে নেয়া হবে।দিনের প্রথম দিকে পড়াশোনা করবে বিকেলে করবে চাকুরী। আগামীকালই সে যোগদান করতে পারবে।এ জন্য তাকে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে।
টাকার কথা শুনে ব্যর্থ মনোরথে অফিস ত্যাগ করে।
একপশলা বৃষ্টি হয়।রাস্তা ঘাটেও পানি জমে।
পার্কের এক কোনে একটি বেঞ্চে বসে আমীর উদ্দিন। আজ বড় আশা নিয়ে এসেছিল। এখন আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। কেন লেখাপড়া করেছিল ভেবে পাচ্ছেনা। ছোট বেলায় বাবার সাথে কাজে লেগে গেলেই বরং ভাল হত। বাবার উপর ধকলটা কম পড়ত।নানা সব চিন্তা মাথায় ভর করে।
তার সামনে বেশ কিছু পানি জমে আছে।মৃদু বাতাসে পানিতে ছোট ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন ছোট্ট এক নদী। পানি দেখে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। বর্ষাকালে বৃষ্টির পর যখ তাদের উঠানে পানি জমত কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসাত।বৃষ্টির পানির স্রোতে নৌকাগুলো উঠানের এ মাথা থেকে ওই মাথায় ভেসে বেড়াত। সে স্মৃতি মাথা চারা দিয়ে উঠে। আমীর উদ্দিন হাতের ফাইলটা খুলে একটা করে সার্টিফিকেট বের করে আর একেকটা নৌকা তৈরি করে।একে একে সব গুলো পানিতে ভাসিয়ে দেয়।মৃদু বাতাসের পরশে নৌকাগুলো ধীর গতিতে দূরে চলে যেতে থাকে। আমীর উদ্দিন দেখতে পায় তার মনের জমাট বাধা কষ্টের পাহাড় নিয়ে নৌকা গুলো চলে যাচ্ছে।
স্লামালেকুম। আসতে পারি?
রিসিপশনে বসা অনুর্ধ পঁচিশ বছরের রমনী আহ্বান জানায়,'হাঁ আসুন'।
আমীর উদ্দিন তার কাছে গিয়ে দাড়ায়।তিনি আসার হেতু জানতে চান। কন্ঠে বলে'পত্রিকায় আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি'। তার জড়তা কাটতে চায়না।
ও হ্যাঁ,এটা শিক্ষিত বেকারদের জন্য আমাদের একটি স্পেশাল কোর্স; তিনমাসের কোর্স। প্রশিক্ষণ দেয়া হবে পাশাপাশি থাকা খাওয়ার জন্য প্রথম মাসে ২০০০,দ্বিতীয় মাসে ৩০০০,তৃতীয় মাসে ৪০০০ টাকা করে দেয়া হবে। পরবর্তীতে চাকুরী হয়ে গেলে মাসে ৫০০০ টাকা সেলারি পাবেন। এক কাজ করুন ২০০ টাকা আর এককপি ছবি দেন,আমি একটা ফরম দিচ্ছি;এখানে একটা স্বাক্ষর করেন। এক ঘন্টা পরে এসে খোঁজ নিবেন।
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে আমীর উদ্দিন,চাকুরী তাহলে একটা জুটে গেল! ছবি , টাকা আর একটা ফরমে সই দিয়ে বেরিয়ে আসে।
কারওয়ান বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে সোনারগাও হোটেলের সামনে এসে দাড়ায়। নিবিষ্ট চিত্তে খুটিয়ে দেখতে থাকে বিল্ডিংটাকে।সে শুনেছে এখানে খেতে গেলে অনেক টাকা বিল দেয়া লাগে।ভাবে চাকুরীটা হয়ে গেলে এদিন এই হোটেলে এসে....। পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে হেটে এফডিসির সামনে আসে।অনেক লোকের জটলা দেখে সেও দাড়ায়।কতক্ষণ পর পর গাড়ি ভিতরে যায় আবার বের হয়।বেশিরভাগ গাড়িই কাল গ্লাসের; ভেতরে কিছুই দেখা যায়না।
পেছনে সরানোর উসিলায় আচমকা এক লোক তাকে সম্মুখ দিক থেকে ধাক্কা দেয়।সময় পেরিযে যাচ্ছে ভেবে আর দাড়ায়না। কারওয়ান বাজারে চলে আসে। এখানে এসে জানতে পারে তার চাকুরী হবে,ভর্তি ফি বাবদ তিন হাজার টাকা দিতে হবে।
মাত্র কয়েশ টাকা আছে তার কাছে।বিনীত কন্ঠে শূধায়'আমার কাছে টাকা নেই,আপনারা প্রশিক্ষণ ভাতা বাবদ যে টাকা দেবেন তার থেকে যদি....।'এটা আমাদের ফি প্রশিক্ষণে যা পাবেন তার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক আছে ,আপনি বাড়ি চলে যান , যেদিন টাকা নিয়ে আসবেন সেদিনই আপনাকে নিয়োগ দিয়ে দিব।
আমীরউদ্দিন বেরিয়ে আসে। ফরম বাবদ যে টাকাটা দিয়েছিল তা ফেরত চাওয়ার ভাষা তার মুখ দিয়ে বের হয়নি। একটি রেস্টুরেন্টএ গিয়ে কিছু খেয়ে বিল দেবার সময় দেখে বুক পকেটে থাকা টাকা গুলো নেই! বুঝতে বাকী থাকেনা এফডিসির সামনের ধাক্কাটা টাকা নেওয়ার মূল হোতা।
ইস্কাটন রোডে আসে। অনেক খুজেঁ একটি ঔষধ কোম্পানীর অফিস বের করে সেখানে গিয়ে দেখে ১০০ টাকা দিয়ে নাম নিবন্ধন করতে হবে।দুটি প্রতিষ্ঠানকে একই মনে করে বাড়ি চলে আসে।
আমীর উদ্দিন বিএ পাশ করেছে দুই বছর হতে চলল। নিম্মবিত্ত পরিবারের ছেলে সে। বাবার নিজের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে।অনেক কষ্ট হয়েছে তাকে পড়াতে। তার জন্য ছোট বোনটাকে বেশি পড়াতে পারেনি। অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হয়েছে।
চাকুরীর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে আমীর উদ্দিন। নিয়মিত পত্রিকা পড়তে পারেনা। শুক্রবারে কেবল পত্রিকা রাখে। মাঝে মাঝে কলেজে একপাক ঘুরে আসে কেবল পত্রিকায় নতুন কোন চাকুরীর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে কিনা দেখার জন্য। প্রায়ই আশাহত হয়ে ফিরতে হয়,আবার কোন দিন কলেজে গিয়ে দেখে বিজ্ঞপ্তির অংশটুকু কে বা কারা কেটে নিয়ে গেছে।
চাকুরী দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন ভিন্নতা দেখেনা সে। সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন জমা নেয়ার আগেই কিছু টাকা নিয়ে নেয় আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নেয় ভিন্ন ছলে। কোনটার প্রতিই তার আস্থা নেই।তবু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখলে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে। তার যে একটা চাকুরী দরকার।
একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিতে যায়।প্রবেশপত্রে সেদিনই ফলাফল দেয়ার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে জানাবে বলে নোটিশ দিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন কোন পত্রের দেখা মেলেনা।
ছয় মাস পর ভাইভা পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এবার হয়তোবা তার চাকুরীটা হয়ে যাবে ভরসায় ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে গিয়ে দেখে যারা রিটেন পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের সবাইকেই ডেকেছে। এ প্রহসনের মানে সে বুঝেনা।সরকারী চাকুরীর প্রতি আস্হা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।
নতুন একটি ঔষধ কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী হয়ে একদিন আবেদন নিয়ে হাজির হয় নোয়াখালী। ট্রেন থেকে নামার সময় ঘটে এক ভয়ানক কান্ড। টিউশনির দেড়শ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। সাথে পকেট কোনে আরো দুই টাকা। ত্রিশ টাকায় টিকেট কাটে। নোয়াখালী স্টেশনে গাড়ী থামার পর দেখে ফ্লাটফর্মের দিকের দরজাটা বন্ধ।বার কয়েক চেষ্টা করে খুলতে না পেরে পরের কামরা দিয়ে নামার জন্য পা বাড়ায়। যেই নামতে যাবে, মোবাইল কোর্টের লোকজন তাকে আটক করে। প্রথম শ্রেনীতে উঠার দায়ে ১২০ টাকা আদায় করে নেয়। হতভম্ব হয়ে স্টেশন ত্যাগ করে অনেক খোঁজাখুজি করে কাঙ্খিত ঠিকানায় গিয়ে দেখে তা বন্ধ। সেদিন রোজা শেষে দুই টাকার মুড়ি কিনে ইফতারী করে যখন বাড়ি ফিরে রাত অনেক হয়ে যায়।
একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। ফের আবেদন করে। অনেক দিন পার হয় ইন্টারভিউ কার্ড আসেনা। আসেনা তো আসেনা।এরি মাঝে আরেকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে। লোক মুখে শুনেছে এই চাকুরী পেতে হলে বড় অংকের টাকা দিতে হবে। টাকা দেয়ার সামর্থ্য তার বাবার নেই। তবু আশায় থাকে।
গ্রামের রাস্তায় বের হলে লোকজন নানা বিরক্তিকর মন্তব্য করে।"দেখ ছেলেটা কত লেখা পড়া করেছে,চাকুরী নাই;আরে এ দেশে মামা দুলাভাই না থাকলে কি আর চাকুরী মেলে? এখন ঘুর। না হালের হয়েছে না হয়েছে জোয়ালের। বাপটা খেটে মরছে উনি নবাবজাদা হয়ে ঘুরে বেড়ান।" এসব শুনতে আর ভাল লাগেনা তাই বাড়ি থেকে বের হওয়া অনেকটা বন্ধ করে দেয়।
একদিন পত্রিকার পাতায় একটি খরব দেখে চোখ আটকে যায় আমীর উদ্দিনের। একটি বেসরকারী ফাউন্ডেশন এইচ এস সি পাশ থেকে শুরু করে এম এ পাশ বেকারদের জন্য বিশেষ এক কর্মসূচী হাতে নিয়েছ। তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করার পাশাপাশি পড়াশোনাও করা যাবে। তাদের পলিসি দেখে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে।
তিনটা ইন্টারভিউ কার্ড একসাথে আসে। বুধবার দিন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাতকার;বৃহস্পতিবার দীর্ঘদিন পূর্বে আবেদন করা প্রতিষ্ঠানের ইন্টারভিউ চট্টগামে আর শুক্রবারে অন্যটার পরীক্ষা কুমিল্লায়। নিজের টিউশনির কিছু টাকা এবং মায়ের কাছ থেকে কিছু নিয়ে রওয়ানা দেয়।
ঢাকায় সাক্ষাতকারের সময় ৪ টা এক ঘন্টা পূর্বেই সেখানে পৌছে। প্রতীক্ষার শেষ হয় সন্ধে সাতটায়। ফাউন্ডেশন প্রধান নাকি অন্য একটি মিটিংয়ে ছিলেন।আমীর উদ্দিনের সাক্ষাতকার শেষে তারা গ্রিন সিগনাল দিয়ে চলে যেতে বলেন। রাতের ট্রেনে চট্ট্রগ্রাম রওয়ানা দেয়।সারারাত না ঘুমিয়ে গাধাগাধি করে বসে থেকে সকালে পৌছে। অচেনা জায়গা চিনতে অনেক কষ্ট হয়। পকেটে অর্থের অভাবে পা দু’টোকেই বাহন বানিয়ে পথ খুঁজতে হয়। দুই ঘন্টা দেরিতে শুরু হওয়া পরীক্ষা শেষ হয় বিকেল ৪ টায়। ফেরত ট্রেন ধরতে হেঁটে পাহাড়তলী আসে। ট্রেন এখানে থামেনা শুনে আবার হেঁটে র্ওয়না দেয় বটতলী স্টেশনে।
রাত আটটায় একপ্রকার যুদ্ধকরে মেইল ট্রেনে উঠে। জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় এখানে।কিছু দালাল গোছের লোক আগেই ট্রেনে উঠে সিট দখল করে বসে আছে।যাত্রীদের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে। পুলিশও কম যায়না। তার ও টাকার বিনিময়ে একটি বগিতে লোক তুলছে। দুই দিনের কর্মক্লাতিতে ট্রেনে উঠার পরই ঘুমে চোখ বুঝে আসে। কিন্তু ঘুমাতে পারেনা যদি ট্রেন কুমিল্লা ছেড়ে চলে যায়। রাত একটায় ট্রেন থেকে নামে। চোখের পাশাপাশি শরীরেও ক্লান্তি ঝেঁকে বসে। একটি বিশ্রাম কক্ষে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুম দিতেই এক পুলিশ ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। বসার সিটটাও হারায়।
ভারসাসম্যহীন শরীরে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে রাতাটা কাটিয়ে সকালে বৃষ্টিতে কাকা ভেজা হয়ে এক স্কুলে হাজির হয়। তার মত হাজার হাজার চাকুরী প্রার্থী পূর্বেই এসে বসে আছে। মাত্র কয়েকটা পোস্টের জন্য এত প্রার্থী!কার হবে চাকুরী ভেবে পায়না। পরীক্ষা শেষে বাড়ী চলে আসে।
আমীর উদ্দিন মনে মনে আশাবাদী হয়ে উঠে,এবার নিশ্চয় একটা চাকুরী হবে। আশাটাকে একধাপ এগিয়ে দিতে সেই বেসরকারী ফাউন্ডেশন থেকে চিঠি আসে। সেখানে উল্লেখ আছে সে নিবর্বাচিত হয়েছে। সকল মূল সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে বলেছে তারা।
সেদিন শুক্রবার। সকালে কাঙ্খিত ঠিকানায় হাজির হয় ।পাঁচজন মানুষ তাকে নানা প্রশ্ন করে। শেষে তারা নিশ্চিত ভাবে জানায় সে নির্বাচিত হয়েছে। চাকুরী করবে পাশাপাশি এম বিএ পড়বে। বেতন হিসেবে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হবে। সেখান থেকে পড়াশোনার ফি হিসেবে আড়াইহাজার টাকা কেটে নেয়া হবে।দিনের প্রথম দিকে পড়াশোনা করবে বিকেলে করবে চাকুরী। আগামীকালই সে যোগদান করতে পারবে।এ জন্য তাকে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে।
টাকার কথা শুনে ব্যর্থ মনোরথে অফিস ত্যাগ করে।
একপশলা বৃষ্টি হয়।রাস্তা ঘাটেও পানি জমে।
পার্কের এক কোনে একটি বেঞ্চে বসে আমীর উদ্দিন। আজ বড় আশা নিয়ে এসেছিল। এখন আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। কেন লেখাপড়া করেছিল ভেবে পাচ্ছেনা। ছোট বেলায় বাবার সাথে কাজে লেগে গেলেই বরং ভাল হত। বাবার উপর ধকলটা কম পড়ত।নানা সব চিন্তা মাথায় ভর করে।
তার সামনে বেশ কিছু পানি জমে আছে।মৃদু বাতাসে পানিতে ছোট ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন ছোট্ট এক নদী। পানি দেখে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। বর্ষাকালে বৃষ্টির পর যখ তাদের উঠানে পানি জমত কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসাত।বৃষ্টির পানির স্রোতে নৌকাগুলো উঠানের এ মাথা থেকে ওই মাথায় ভেসে বেড়াত। সে স্মৃতি মাথা চারা দিয়ে উঠে। আমীর উদ্দিন হাতের ফাইলটা খুলে একটা করে সার্টিফিকেট বের করে আর একেকটা নৌকা তৈরি করে।একে একে সব গুলো পানিতে ভাসিয়ে দেয়।মৃদু বাতাসের পরশে নৌকাগুলো ধীর গতিতে দূরে চলে যেতে থাকে। আমীর উদ্দিন দেখতে পায় তার মনের জমাট বাধা কষ্টের পাহাড় নিয়ে নৌকা গুলো চলে যাচ্ছে।