একদিনের ট্রেন ভ্রমণ (পরের পর্ব)

Posted by zhsoykot On মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫ 0 মন্তব্য(গুলি)

নগরীর চৌহাট্টা পয়েন্টে বন্ধুর অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছি। আমার আগেই তার আসার কথা থাকলেও অফিসের কাজের জন্য দেরি য়ে গেছে। মোবাইলে একটা মেসেজ আসে। স্ক্রিণে চোখ রাখি সেটা দেখার জন্য। এক্সকিউজ মি..একজন আমার দৃষ্টি আর্ষণ করায় তার দিতে তাকিয়ে বলি-ইয়েস। আপনি কি কারোর অপক্ষোয়? জ্বী…. কিন্তু (আপনার নয়) পরের শব্দ দুটি অনুচ্চারিত থেকে যায় বা মনে মনে বলি। আমার চাহনি দেখে বুঝতে পারেন যে আমি তাকে চিনতে পারিনি। নিজ থেকেই পরিচয় দেবার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করেন- আমাকে চিনতে পারেননি বোধয়; মাস দুই আগে চট্টগ্রাম যাবার পথে ট্রেনে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল.. মানুষের চেহারা মনে রাখতে না পারার অপারগতার কথা জানিয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। এবার তার চেহারাটা মনে পড়ে। জানতে চাই – এখানে কোথা থেকে? স্কুল থেকে ফিরছি। আপনি কার অপেক্ষায়? এক ফ্রেন্ড আসছে। সে আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবে। আপনিতো শহরে থাকেননা; অনেক দূরে থাকেন। তাহলে এ শহরে আপনার বন্ধু থাকে কি করে! কথাটা আমাকে খোঁচা দিয়ে বলা বুঝতে পারি। আমি স্বাভাবিক জবাব দিই- শহিদ মিনারের সামনে পহেলা বৈশাখে টিএসতে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়নের মানব বন্ধন চলছে দেখে আসলাম। সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও আমার বন্ধু তালিকায় আছে। তাই নাকি? আগে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন নাকি? নাহ… তার সাথে ব্লগের মাধ্যমে মাধ্যমে পরিচয়। ও। আপনিতো লেখালেখি করেন। এ শহরে আপনার অনেক বন্ধু। তার কথায় কিঞ্চিত বিস্মিত হই।এ খবর আপনি জানেন কি করে? সে কথা পরে বলছি, আপনি চলুন আার সাথে। কোথায়? আমাদের বাসায়। আমার বন্ধু সম্ভবত আশ পাশেই চলে এসেছে। আপনার সাথে যেতে পারছিনা, সরি। সরি বললে তো হবেনা, মাকে যে কথা দিয়েছি, আপনার সাথে দেখা হলেই আপনাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাব! বলেন কি! হ্যাঁ। সেদিনের পর মা আমাকে এবং আপনাকে ইচ্ছেমত গালাগাল করেছেন! দীর্ঘ ১৭ ঘন্টা একসাথে পাশাপাশি থাকার পরও কেউ কারোর নাম বা যোগাযোগের ঠিকানাটা নেইনি বলে। আমার বন্ধু উপস্থিত হয় আমাদের কথার ফাঁকে। শিল্পকলা একাডেমিতে একটা অনুষ্ঠানে আমাদের যাবার কথা। আমি কিছু বলার আগেই উনি তার ইচ্ছের কথা বলেন। আমাকে আপাতত উদ্ধার করবে এই ভরসায় প্রস্তুতি নেবার প্রাক্কালে বন্ধু বলে উঠে- এমন সুন্দর একজন মানুষ অনুরোধ করছে সাথে নিয়ে যাবার জন্য, তুই কেমন মানুষরে! আমি হলে এতক্ষণে বাসায় পৌছে যেতাম। আমার অন্য একটা কাজ আছে, আজ আর শিল্পকলায় না যাই বলে বন্ধু যেন আমাকে অথৈ জলে ফেলে ফেলে সটকে চলে যায়। একটু দ্রুত চলুন। বৃষ্টি আসতেছে বলে হাঁটতে শুরু করেন । আমার সাথে রিক্সায় না উঠার কৌশলটা তা বুঝি! আমি লেখালেখি করি আপনি জানেন কিভাবে? আপনার ফেইসবুক থেকে। আপনি বলছেন আমার নাম জানেনা আর আমার ফেইসবুকের একাউন্টতো ভিন্ন মানে আমার নামের সাথে মিল নেই ? আর আপনি আমার বন্ধুর তালিকায় আছে বলে তো মনে পড়ছেনা। কারণ গত কয় মানে হাতেগোনা যে কয়জন বন্ধু হিসেবে তালিকায় যুক্ত হয়েছে তাদের সবাই মোটামুটি চেনা জানা। আপনার মোবাইলের সেটিং সমস্যার কারণে একবার আমাকে আপনার মোবাইল দিয়েছিলেন মনে আছে? তখন আপনি ফেইসবুকে লগইন অবস্থায় ছিলেন। তখন আপনার আইডিটা চোখে পড়েছিল। আমি আপনার এফবিতে বন্ধু তালিকায় নেই কিন্তু আপনার সকল আপডেট আমি জানি। আপনার প্রোফাইল থেকে আপনার সমন্ধে কিছু না জানা গেলেও আপনার সকল লেখা পড়া যায় অনায়াসে। আপনার লেখা আমার ভালো লাগে তাই আপনার সকল লেখা আমার পড়া হয়ে গেছে। আপনার পেজের বাম দিকের নিচের অংশে একশত একুশটা নোট আছে সব গুলো আমার পড়া! একটা ব্লগ কি যেন নাম এই মুহূর্ত ভুলে গেছি সেখানকার লেখা গুলোও আমার পড়া হয়ে গেছে। আচ্ছা এখন ব্লগে লিখেননা কেন? এক সময় ব্যস্ততায় ব্লগে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভাবছি আবার লেখালেখিটা শুরু করব। আচ্ছা আপনার ছবি গল্পের নায়িকার সাথে যোগাযোগ আছে? বিভিন্ন দিবসে মাঝে মাঝে তাকে মেসেজ দেই শুভেচ্ছা পাঠাই। তার সাথে কি আপনার একবারই দেখা হয়েছিল? কয়েকবার দেখা হয়েছে। সত্যি, তার বাসায় গিয়েছেন কখনো? না। কেন তার স্বামী মানে আপনার শিক্ষক কিছু মনে করবেন এই কারণে? তার তো বিয়েই হয়নি! বলেনকি! সত্যি তার বিয়ে হয়নি? তাহলে আপনি গল্পে এমনটি করলেন কেন? সে অনেক কথা। একজনার কথার প্রেক্ষিতে এমনটি করেছিলাম। তবে গল্পটা লেখার পর তাকে দিয়েছিলাম। তাকে এও বলেছিলাম- আমি গল্পের একটা সমাপ্তি টেনেছি তিনি যেভাবে চান সেভাবেই আমি শেষ করব। তাই নাকি? তা উনি কি বলেছিলেন? গল্পকার যেভাবে লিখেছেন সেভাবেই থাক। তবে আমার ধারণা। গল্পের সমাপ্তি তার পছন্দ হয়নি। আপনার চিঠিগুলো অসাধারণ। আমি বারবার পড়ি। আমার অনুমান দুইটি চিঠি একজনকে নিয়ে লিখা। হতে পারে। ঠিক মনে পড়ছেনা। বুঝতে পারি আমার লেখার মান যাই হোত একজন সমঝদার পাঠক পেয়েছি। আরো কিছু প্রশ্ন করি। আপনি মনে কিছু নেবননাতো? আমি আপনাকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছিনা আপনার লেখার প্রেক্ষিতে লেখককে প্রশ্ন করছি। কোনো একজনকে লেখক (আপনি) ভালোবাসতেন। উনি নিজ থেকে দূরে চলে গেছেন। তাপরও লেখক তাকে কেন ভালোবাসেন এখনো? আমরা বাসায় চলে আসি। আমাকে ড্রয়িংরোমে রেখে ছুটে গিয়ে তার মাকে নিয়ে আসেন। দেখ মা কাকে নিয়ে এসেছি। আমাকে দেখেই তিনি চিনে ফেলেন। একসাথে চিটাগাং গিয়েছিলামনা আমরা? কেমন আছ তুমি? জ্বী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? আমরাও ভালো আছি। মা তোমরা কথা বল। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি বলে পাশের রোমে যাবার পথে তাকে ডাক দিয়ে দাড় করান । মিতা শোন, একটু চায়ের পানি চুলোয় বসিয়ে দিসতো। তুমিতো কিছুটা শুকিয়ে গেছ। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করোনা নাকি? চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পর পরিচিত সবাই বলাবলি করছিল আমি নাকি খানিকটা মোটা হয়ে গেছি। সেটা কন্ট্রোল করার জন্য খাদ্য তালিকা সামান্য পরিবর্ণ করেছি।। কি বলছ এসব! এ বয়সে এত কিছু হিসেব করে চললে হবে এ বয়সে সারাদিন বেশি বেশি করে খাবে কেমন? ও হ্যা তোমার পরিবারের লোকজন কেমন আছে? বাড়িতে গিয়েছিলে কি এর মাঝে? জ্বী বাড়ির সবাই ভালো আছে। অফিসের ব্যস্ততা এবং অন্যান্য কাজে বাড়ি যেতে পারছিনা । তবে যোগাযোগ আছে। আচ্ছা এখান থেকে গিয়ে কি তুমি অফিস করতে পারবে? মানে তোমার অফিস কি অনেক দূর? খানিক দূর বটে। তবে অনেকে এ শহর থেকে গিয়ে প্রতিদিন অফিস করে। তাহলে … এরি মাঝে মিতা রোমে প্রবেশ করে। সে মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জানতে চায় তাহলে কি মা? বলছিলাম আমাদের নিচ তলার এক পাশ তো খালি পড়ে আছে। ওর যদি সমস্যা না হয় তাহলে আমাদের বাসা থেকে আসা যাওয়া করে অফিস করতে পারে। আর খাওয়া দাওয়াটা ও আমাদের সাথে করতে পারে। দেখনা কেমন শুকিয়ে গেছে। কি সব যে রান্না করে বুয়ারা। খানিকটা রকিতার ছলে মিতা বলে তাহলেতো ভালই হয়, তাকে আর খুঁজে খুঁজে বের করে আনতে হবেনা। মিতা আমাদের পাশে এসে বসে। তার মা চা আনতে অন্য রোমে চলে যান। মা তো আপনাকে আমাদের বাসায় থাকতে বলছেন ,আপনার আগ্রহ আছে নাকি? না। দূর হয়ে যায়। আর মাঝে মাঝে তখন তখন অফিসে যাওয়া লাগে। আসতে চাননি এবার দেখলেন তো আপনাকে মা কতটা ভালোবাসেন। দিন শেষে বাসায় ফিরলে প্রায়ই জানতে চান আপনার সাথে দেখা হয়েছে কিনা। দেখলেননা আপনি শুকিযে গেছেন সেটাও উনার নজর এড়ায়নি। আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি? কোনটির? লেখক কেন এখনো তার প্রিয় মানুষকে ভালোবাসে? ওই লেখাগুলো অনেক আগের। এখন আর তাকে ভালোবাসে বলে আমার মনে হয়না। তাই নাকি? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়া যায়া যায়? আপনার জীবন থেকে এর উত্তর দেন আগে আমি পরে আমারটা বলছি। তার মা চা, বিস্কিট, সহ নানা ধরণের ফল ট্রেতে করে নিয়ে আসেন। চা পান করতে করতে বলেন-আমি ভেবে দেখলাম তোমাদের দুজনের মাঝে বেশ মিল আছে।তোমরা দুজনেই বয়সে বেশ পরপক্ক। তাই সরাসরিই বলি।তোমরা যদি মতামত দাও আমি তোমাদেরকে একত্রে করে দিতে চাই। এমন কথা শোনার জন্য আমার কেউই প্রস্তুত ছিলামনা। একে অপরের মুখের দিকে একবার তাকাই আবার তার মায়ের মুখের দিকে। আমাকে বাসায় ধরে এনে এমন কান্ড ঘটাবে মিতা ভাবেনি। সে কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা। আমার দিকে আর তাকাতে পারেনা। চোখ নামিয়ে নেয়। আমি বিষয়টিকে সহজ করার জন্য বলি বলছিলাম কি আমার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে নিন আপনি। তারা যদি মতামত দেন… আমিতো এক পক্ষের অভিভাবক, অন্য পক্ষকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। তোমার মতামত বল খানিব সময় নিয়ে বলি- একটু ভেবে বলি। আমার কখা শেষ না হতেই মিতাও বলে উঠে- আমি ভেবে বলি!

ট্রেন ছাড়ার সময়ের আধঘন্টা পূর্বে স্টেশনে হাজির হই। প্লাটফরমে যাত্রী বলতে গেল নেই ই। মনে ভয় জাগে ট্রেন কি তবে চলে গেছে! মাঝে মাঝে মোবাইলে সময় উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। আজ কি তবে….। একজনার কাছে জানতে চাই সময় কত হলো। তার কথায় নিশ্চিত হলাম আমি আধঘন্টা আগেই এসেছি। কিন্তু স্টেশনে যাত্রী নেই কেন? ট্রেনও তো প্লাটফরমে দাড়িয়ে থাকার কথা। স্টেশনের অনুসন্ধান রোমের দরজা বন্ধ। সহকারী স্টেশন মাস্টার তার রোমে নেই। কিছু লোক সেখানে দাড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছেন। একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করেই চলছেন; কোনে উত্তর মেলেনা। সবাই বলাবলি করছে ট্রেন লেট, তবে কত সময় লেট কেউ জানেনা। রোমের দরজার পাশে দেয়ালে একটি কাগজ সাটানো আছে । সেখানে কয়েকটি ট্রেনের নম্বর ও একটি এসএমএস করার নম্বর দেয়া আছে ; ট্রেনের নাম লিখে মেসেজ পাঠালে ট্রেনের অবস্থান জানা যাবে। কয়েকজন চেষ্টা করে দেখছেন ট্রেনের অবস্থান জানার জন্য। আমিও কাঙ্ক্ষিত ট্রেনের অবস্থান জানার জন্য একটা মেসেজ পাঠাই। ফেরত মেসেজে জানানো হয় বিকেল ৩.১৫ সময় ট্রেন ছাড়তে পারে! মাত্র দশটা বাজে। বাসায় যেতে ১ ঘন্টা লাগবে। আবার ফিরতে একঘন্টা। মাঝে ৩ ঘন্টা সময় বিশ্রাম করে আসা যাবে। কিন্তু যেতে মন চাইছেনা। প্লাটফরমে এত সময় বসে থাকাও সম্ভব নয়। কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে ভালো হতো। হাতে বেশ নাদুশ নুদুশ একটা ব্যাগ। এটা নিয়ে হাঁটাও যাবেনা। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে পরিচিত একজনার বাসার দিকে রওয়ানা দিই। তার বাসায় যাবার পথে অন্য একজনার সাথে দেখা হয়। তাকে ব্যাগটা গছিয়ে অনির্ধারিত গন্তব্যে রওয়ানা দিই। যদি ট্রেন চলে যায় এই শংকায় তিনটার আগেই স্টেশনে পৌছে খবর নিয়ে জানতে পারি ট্রেন ডকে আছে। ফ্লাটফরমে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করি। আমার বসার স্থানের পাশেই পুলিশ ফাড়ি। দশ বারো বছরের একটি ছেলে সহ এক মহিলা এসে চারদিক সরগরম করে তুলেন। তিনি পাশের এক চায়ে দোকানে ব্যাগ ভুলে ফেলে এসেছিলেন। এখন দোকানদার ফেরত দিচ্ছে না। তার কথায় কয়েকজর পুলিশ সেই দোকোনের দিকে রওয়ানা হয়। একটু পরে পুলিশের লোকজন ফিরে আসে। খানিক বাদে মহিলাও আসেন। আবার শুরু করেন চেচামেচি! তার মতে দোকানদারের সাথে পুলিশ আতাত করে ব্যাগ মেরে দিয়েছেন! আর দোকানদারে ভাষ্য ব্যাগ দোকানে রাখেনননি, অন্য কোথাও….। তাই পুলিশের কিছু করার নেই। একজন পুলিশের সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমার এলাকার লোক। তার সাথে কথা বলতে বলতে ট্রেন এসে দাড়ায় সামনে। আমাকে সাথে করে নিয়ে চলেন সিট দেখিয়ে দেবার জন্য। ট্রেনের একেবারে সামনের বগিতে সিট। সিটের পাশে দাড়িয়ে নানা উপদেশ ও পরামর্শ্ দিতে থাকেন। আমি সুবোধ ছেলের মত গোগ্রাসে গিলতে থাকি সেসব। যাত্রীরা উঠতে শুরু করেছে ততক্ষণে। তিনজন যাত্রী সিট খুঁজতে খুঁজতে আমাদের সামনে এসে দাড়ায়। একজন বয়স্ক পুরুষের সাথে মহিলা এবং একটি মেয়ে। সাথে থাকা দুইটি বড় ব্যাগ উপরে রাখতে গেলে আমি এবং আমার সঙ্গী মিলে হেল্প করি। তাদের তিন সিটের ২ টি আমার বাম পাশে; অন্যটি আমার সাথে। বামপাশের জানালার পাশে বয়স্ক মহিলা বসেন। তার পাশে বসার জন্য বৃদ্ধ লোকটি মেয়েটিকে আদেশ করেন। সে জানায় জানালার পাশে বসবে এবং আমার সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ বাধা দিয়ে বলেন- কে…না… কে এখানে বসে…..। আমি জানাই ‘ বসুক কোন সমস্যা নেই, পাশের সিট আমার’। আমি পুলিশের সাথে নিচে নেমে যাই। ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময় পেয়ে যায় । ট্রেন ছাড়েনা। প্লাটফরমে অপেক্ষা করতে থাকি। একটা পত্রিকা কিনে ট্রেনে ফিরে আসি। দেখি মেয়েটি বাইরে জানালার পাশে দাড়ানো একটি ছেলের সাথে কথা বলছে। কারো দিকেই আমি তাকাইনা। ট্রেন কেন ছাড়ছেনা এই ভেবে বিরক্ত লাগে। আমার বিরক্তি বেড়েই চলে। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটায় ট্রেন ছাড়ে। আমি আমার সিটে এসে বসি। কিছুটা অস্বস্থিঃ অনুভব করি। আমার সিটের বাম পাশের হাতল নেই। ডান দিকে হেলান দিতে গেলে পাশের যাত্রীর গায়ে শরীর লেগে যায় ভয়ে পারিনা। স্বাভাবিক হতে পত্রিকায় চোখ বুলাই। পাতা মেলতে গিয়ে একবার দুই সিটের হাতলের উপরে রাখা পাশের যাত্রীর হাতের সাথে হাত লেগে যায়। উনি হাত নামিয়ে নেন। আমি পত্রিকার পাতায় মনোনিবেশ করি। (২) পত্রিকা পড়ায় সামান্য বিরতি দিই। পাশের যাত্রী মোবাইলে ব্যস্ত। হয়তো ফেসবুকে মশগুল। দুই হাত সমানে চলছে মোবাইলের স্ক্রীণে। এক হাতের কনুই ডান পাশের হাতলের উপর। আরেকটা হাত বামপাশের হাতলে রাখলে তার সুবিধে হয় কিন্তু হাতলটা দু‘জনের সিটের মাঝে হওয়ায় তার অর্ধেকটার (জার্নি শেষ না হওয়া পরযন্ত) মালিকানা দুইজনের এই ভেবে কদাচিত হাতলের উপর হাত বেখেয়ালে চলে এলেও সেটা আবার নামিয়ে নেন। কয়েকবার বিষয়টি আচঁ করতে পেরে আমি বলি- আপনি হাতলে হাত রাখুন, কোনো সমস্যা নেই। স্বতর্স্ফুর্ত ভাবে বা সৌজন্যাবোধ থেকে তাৎক্ষণিক জানতে চান- আপনার ওই পাশে হাতলটা নেই না? জ্বী, ভাঙ্গা। তাহলে আপনি এই হাতলে হাত রাখুন। আমার এপাশে একটা আছে। না আপনিই হাত রাখুন। আমার পাশে যেহেতু হাতল নেই মাঝেরটাও না ব্যববহার করি! গাড়ির গতি বেশ মন্তর। কত সময় পর পর ইচ্ছেমত যাত্রাবিরতি দিচ্ছে। দরজা জানালা সব বন্ধ থাকায় দিনের আলো শেষ হবার পূর্বেই আন্ধকার ঘনীভূত হয়। পত্রিকা পড়তে বেশ সমস্যা হয়। পাতা গুটিয়ে সামনের সিটের পেছনের খোঁপে গুঁজে রাখি। ট্রেনের লাইটগুলো জ্বলে উঠে। যাত্রীদের মুখগুলোও যেন উজ্জ্বল আভায় রাঙিন উঠে। আমি আবার পত্রিকা খুলে একটা কলাম পড়ায় মনযোগ দিই। আমার পাশের যাত্রী তার ব্যাগ থেকে একটা চিপসের প্যাকেট বের করে সেটার মুখ খুলে নিজে কয়েকটা নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে বলেন- নেন… ধন্যবাদ। আপনি খান ,আমি চিপস খাইনা। ও… ওজন বেড়ে যাবে এই ভয়ে চিপস খাবেবনা! (চিপস খেলে ওজন বাড়ে আপনার চেহারা দেখে সে কথার সপক্ষে প্রমাণ মেলেনা! মনে মনে বলি) না তা হবে কেন? আমি এমনিই খাইনা। আমার কাছে মনে হয় এটা ছোটদের খাবার। আচ্ছা নিচ্ছি বলে কয়েকটা চিপস হাতে নিই। পত্রিকাটা বন্ধ করে তার দিকে মনযোগী হই। ওহ.. আপনিতো বড় হয়ে গেছেন, আমি এখনো ছোট কিনা। আমি এবার তার মুখের দিকে তাকাই। মনে হলো স্রষ্টা দুনিয়ার তাবৎ সৌন্দর্য এক করে তার মাঝে দিয়ে দিয়েছেন! বয়স আন্দাজ করতে পারিনা। বলে নেয়া ভালো যখন বাইরে দাড়ানো ছেলেটির সাথে কথা বলছিল তখন মনে হচ্ছিল ভার্সিটি পড়ুয়া হবেন। এখন কিছুই অনুমান করতে পারছিনা। আপনার বাড়ি কি চিটাগাং? আবার চিপসের পেকেটটা বাড়িয়ে দিতে দিতে জানতে চান না। আমি একটা কাজে যাচ্ছি। সিলেটেই থাকেন বুঝি? জ্বী। তবে ঠিক শহরে না। একটু দূরে গোলাপগঞ্জ। আপনার বাড়ি কোথায়? অবশ্য বলতে চাইলে প্রয়োজন নেই। আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কাজের সূত্রে সিলেটে থাকি। আমার বাড়ি সিলেটেই। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি চিটাগাং চিপস খেতে খেতে জেনে নেন আমি কি করি, কেন চট্টগ্রাম যাচ্ছি , কতদিনবা থাকব ইত্যাদি ইত্যাদি। কুলাউড়া স্টেশনে গাড়ি থামার পরে আর ছাড়ার নাম নেই! বাস হলে এত সময়ে যাত্রীগন ড্রাইভারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে নিতেন। কেউ কেউ রেলওয়েল কর্তাগণের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। কেউ কেউ জানালা খুলে বাইরের দিকে দেখছেন। সন্ধের আবছা আধার নিকষ অন্ধারে বিলীন হবার পথে। (অসমাপ্ত)

এক্সিবিশন শুরু হয়েছে সকাল নয়টায়। সন্মেলন কেন্দ্রে পাশ দিয়ে যাবার সময় ভাবনায় আসে একবার ঢু মেরে যাবার। তাই অরণ্যর আসা। প্রদর্শনী দেখে রীতিমত মুগ্ধ হয় । এত সুন্দর একটা প্রদর্শনী মিস হয়ে যেত ভেবে বেশ আফসোসই হচ্ছিল। তুঁলিঁর আচড়ে ফুটিয়ে তোলা থেকে শুরু করে পুরোনো সাদা কালো এমনকি হালের আধুনিক ক্যামেরার সাটার চেপে উঠানো আলোকচিত্র দিয়ে পুরু মিলনায়তন সাজানো হয়েছে। দর্শনাথীদের আনাগোনাও প্রচুর। কেউ কেউ কাছে গিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে ছবি। ছবি তোলা অরন্যর অন্যতম শখ। প্রদর্শনী কেন্দ্রে প্রবেশ করেই তার ক্যামেরা অন করে সাটার টিপতে শুরু করে। ছবি গুলো লেন্সের পর্দায় দেখে আর পছন্দ মত ক্যামেরায় তুলে নিতে থাকে। অরণ্যর ক্যামেরার সাটার কতক্ষণ পর পর এক একটা দৃশ্যকে ফ্রেম বানিয়ে তা বন্দী করতেই থাকে। এক সময় একটা দৃশ্যে চোখ আটকে যায়। সারি সারি গাছের পাতা ভেদ করে সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি শিশির কণার উপর পতিত হচ্ছে আর সেদিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে এক কিশোর। দৃশ্যটা তার কাছে জীবন্ত মনে হয় যেন ইচ্ছে করলেই তাকে ছোঁয়া যাবে। সেই জীবন্ত দৃশ্যটাকে ফ্রেমবন্দী করার জন্য ক্যামেরার সাটার টিপে। ছবিটা উঠে তবে আরেক জনের মুখাবয়ব সহ। সেই মুখ দেখে আরো বেশি চমকিত হয় অরণ্য। এবার ক্যামেরার আলোকবিন্দু সেই মুখের পানে নিবিষ্ট হয়। দর্শনার্থীর চোখ ছবিতে বিমুগ্ধ থাকায় পর পর কয়েকবার ক্যামেরা ক্লিক করলেও ঠিকমত ছবি তুলতে পারেনা। দুজন মুখোমুখি হয়। প্লিজ আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? অরন্যর বিনয়ী কথায় আর না করতে পারেননি । সাবলীল ভঙ্গিতে ছবি তোলায় সহায়তা করেন। বিভিন্ন এংগেল থেকে বেশ কয়টি ছবি তুলে নেয়। ছবি তোলার ফাকেঁ তিনি জানতে চান। আমাকে কি ছবি গুলো দেয়া যাবে? কেন নয়? আপনার ইমেল এড্রেস দিলে আমি পাঠিয়ে দিব। আমার কোন ইমেইল এড্রেস নেই। তাহলে আপনার ঠিকানা দিলে আমি নিজেই পৌছে দিয়ে আসব। আমার মোবাইল নম্বরটা রাখুন,পরে আপনার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিব না হয়। ঠিক আছে দেন। আচ্ছা ওই দিকটায় আর কয়েকটা ছবি তুলে দিবেন? তিনি মঞ্চের দিকে ইংগিত করেন। নম্বর দিতে দিতে অরণ্য আহ্বান করে চলুন….. ঠিক সেই মুহূর্তে অরণ্যর ফোনটা বেজে উঠে। রিসিভ করে কিছুই শুনতে পায়না। কথা শুনার সুবিধার্থে কোলাহল ছেড়ে একটু আড়ালে চলে আসে।বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তখনই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য এক বন্ধু অনুরোধ করে। কলটা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে চট জলদি আরো কয়টা ছবি তুলে বিদায় নেবার জন্য। সেখানে গিয়ে দর্শনাথীকে আর খুঁজে পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে অরণ্য ছবি গুলো এডিট করতে বসে।বেশ ভাল ছবি উঠেছে। বিশেষ করে একটি ছবি এতই সুন্দর উঠেছে যে সে চোখ ফেরাতে পারেনা। এমন মায়াবী টানা টানা চোখে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে সাধ্য কার! বেশ সময় নিয়ে নিখুঁত ভাবে ছবিটা এডিট করতে থাকে।যেভাবেই দেখে যে রঙে রাঙাতে চায় সে রঙেই অনবদ্য আকার ধারণ করে । ভাবনায় ও পড়ে। এত সুন্দর মানুষ হয় কি করে? সৃষ্টিকর্তা কি দুনিয়ার তাবৎ সৌন্দর্য তার মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন? হয়তোবা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে ছবির পানে। ছোট বোন চৈতির ডাকে তার সম্বিৎ ফিরে। কিরে এমন ধ্যানমগ্ন হয়ে কি দেখছিস? দেখি দেখি ছবিটা কাররে ভাইয়া? দেখতে তো বেশ। না কিছুনা। কিছুনা মানে আমিতো দেখছি তুই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছিস? কে মেয়েটি? চিনিনা। আজ এক্সিবিশন থেকে তুলেছি। চিনিসনা তাহলে ছবি তুললি যে? ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ সামনে পড়ে গেল। তা পরিচয় জানবিনা? সময় ছিলনা। তোর আর এ জীবনে সময় হবেনা। অরণ্য কিছুটা ক্ষেপে যায়। পাকামি বাদ দিয়ে বল কি জন্য এসেছিস? একটা মেইল করতে হবে। চৈতিকে পিসি দিয়ে অরণ্য উঠে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে অরণ্য ইমেইল চেক করার জন্য পিসি অন করতে গিয়েই চোখের পর্দায় বড় একটা ধাক্কা খায়। চৈতি ডেক্সটপের স্ক্রীনে সে ছবিটা সেট করে রেখেছে। এত সুন্দরভাবে ছবিটি ফুটে উঠেছে মনে হয় যেন কোন চিত্র শিল্পী বেশ যতন করে সৃষ্টি করেছে । চমৎকার স্লিম গড়ন,কাজল টানা দুটি চোখ,ডান পাশের ঠোটেঁর কোনে একটা তিলক চিহ্ন। ছবিট যেন অপূর্ব সৌন্দর্যের এক আধাঁর। এমনভাবে ছবিটি তোলা হয়েছে দেখলে মনে হয় পলকহীন তাকিয়ে আছে। প্রথমবার ছবি দর্শনের সাথে সাথে অরণ্য চোখাচোখির লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। দ্বিতীয়বার চোখ মেলার পর আর পলকই ফেলতে পারেনা।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ নয়নে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করেনা। ভার্সিটিতে যাবার সময় হয়ে যায় অরণ্যর খেয়ার থাকেনা। মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে। দ্রুত পিসি বন্ধ করে বাসা থেকে দৌড়ে বের হয়।ক্লাশে যেতে দশ মিনিট পেরিয়ে যায়।ক্লাশে বসে পাঠে মনযোগে ভাটা পড়ে। চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই ছবিটা। ইচ্ছে করলেও সেটা সরাতে পারেনা। ক্লাশ শেষে ল্যাবে যায় ছবি প্রিন্ট করার জন্য।সেখানে গিয়ে মনে পড়ে ছবিই নেয়া হয়নি। বিকেলে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরোলেও আড্ডায় মন বসেনা। অস্থিরতা কাজ করে মনে।কী যেন খুজেঁ বেড়ায়। আনমনা হয়ে যায় বারবার। বন্ধুরা প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যায়। কিছু সময় পর পর ছবির ভাবনা মনের কোনে ভিড় জমায়। আড্ডা শেষ হবার অনেক পূর্বেই অন্যদের ছেড়ে চলে আসে বাসায়। তখন ছবি আরো বেশি চুম্বকের মত টানে তাকে।পিসি খুলে এডিট করা ছবি গুলো ফের বিভিন্নভাবে নানা আকারে সাজায়। কত সময় ধরে এক একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছুটির দিনে অরণ্য অনেকটা সময় বাইরে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আজ আর ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছেনা।এ রোম থেকে ওই রোম;কখনো বিছনায় শুয়ে এবং এলোপাথাড়ি ভাবনার ঘোরেই দিনটা কাটিয়ে দেয়। শেষ বিকেল একবার ইচ্ছে জাগে ল্যাবে গিয়ে ছবি গুলো প্রিন্ট করিয়ে আনার কিন্তু কোন কিছুই হয়ে উঠেনা। ভার্সিটিতে যাবার সময় মনে করে পেনড্রাইভটা সঙ্গে করে নিয়ে নেয়। ছবি গুলো কেমন হল এক নজর দেখার জন্য মন আর সয়ছেনা যেন। এক ক্লাশ বাদ থাকতেই ল্যাবে গিয়ে উপস্থিত হয়। দেখে বিদ্যুৎ না থাকা ল্যাবের লোকজন খোশ গল্পে মত্ত। তিনদিন পর ছবি হাতে পায় অরণ্য। এবার অস্থিরতা আরো বাড়ে। একটা ফোনের অপেক্ষায় এ অস্থিরতা। কবে সে কাঙ্খিত মানুষটি ফোন দিবে। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতাশা করে সে ফোনের। কত সময় পর পর মোবাইলের দিকে তাকায়,কোন অপরিচিত নম্বর থেকে কল এল কিনা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অন্ধকার হাতড়ে মোবাইলটা খুজেঁ দেখে ফোন এল কিনা। রাত বিরাতে সময়ে অসময়ে ফোনটা বেজে উঠে। রিং শুরু হলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে। ছবির মানুষটি বুঝি ফোন দিল! প্রতিদিন অপ্রত্যাশিত অনেক ফোন এলেও অরণ্যর প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটেনা। চাতক পাখির ন্যায় সে একটা ফোনের অপক্ষোয় থাকে। নিজ থেকে ছবি চেয়ে ফোন নম্বর নেবার পরও কেন একবারও যোগাযোগ করেনি বিষয়টি বুঝে উঠেনা অরণ্য। তখন কেন তার নম্বরটা নেয়নি ভেবে প্রচন্ড রাগ হয়। এত অবশ্য তাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট। হুট করে কারোর সাথে মিশতে পারেনা। না হয় নিজের নম্বর দেয়ার পরিবর্তে তার নম্বরটা চেয়ে নিতে পারত। সময় যায় ;ফোন অসেনা। অরণ্য আশা ছাড়েনা।নিশ্চয় একদিন ঠিকানা পাবে ছবি গুলো পৌছে দেয়ার জন্য। শুধু ফোনের প্রত্যাশায় না থেকে চলতি পথে যদি কোথাও দেথা হয়ে যায় ভেবে ছবি গুলো নিজের সঙ্গেই রাখে। যখনই পিসি অন করে ডেক্সটপের ছবিটাসহ প্রতিটি ছবি বেশ সময় ধরে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখে। যতবার দেখে প্রতিবারই নতুনত্ব নিয়ে ফুটে উঠে ছবি গুলো। দেখে যেন তৃষ্ণা মেটেনা। কখনো কখনো প্রিন্ট করা ছবি গুলোও নাড়া চাড়া করে দেখে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষে একটা চাকুরী ও পেয়ে যায়।অফিস মতিঝিলে। মিরপুর থেকে মতিঝিল যেতে এবং আসতে প্রতিদিন অনেক নতুন মুখের দেখা মেলে। ভরসা পায় কোন একদিন সে মানুষটিরও দেখা পেয়ে যাবে। যে খানেই কোন প্রদর্শনীর খবর পায় ছুটে যায় অরণ্য। প্রদর্শনীর চেয়ে আগত দর্শনার্থীদের প্রতি নজর থাকে বেশি। অগনিত মানুষের ভীড়ে খুজেঁ ফিরে যাকে একদিন ক্যামেরাবন্দী করেছিল। বারবার হাতের স্পর্শে ছবি গুলো মলিন হয়ে যায়। নতুন করে প্রিন্ট করিয়ে নোর জন্য। সেখানে দেখা হয় এক বন্ধুর সাথে। জানতে চায় মেয়েটি কে? কয়দিন পূর্বে এক বন্ধু এক মেয়ের ঠিকানা দিয়েছিল একটা লিটলম্যাগ পাঠানোর জন্য। সে মেয়েটি কিনা জানতে চায়। অরণ্য জানায় যে ছবির মানুষটির সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। সপ্তাহে ছয় দিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত অফিস। যাওয়া আসার আরো ঘন্টা তিনেক।চক্রাকার বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায় অরণ্যর জীবন।শুধু ছুটির দিন গুলোতে খানিক বেড়ানোর সুযোগ মেলে। অন্যদিন গুলো কোন দিক দিয়ে চলে যায় খেয়ালই থাকেনা। এত ব্যস্ততার মধ্যে একজনার কথা মনে থাকে। কখনো কাজের ফাকেঁ, কখনো অবসর মুহূর্তে কিংবা প্রচন্ড ব্যস্ততার মাঝেও যে ছবিটি তার মনের কোনে ভেসে উঠে;যার কথা নিজের অজান্তেই মনে পড়ে সে..। প্রতিনিয়ত তাকে খুজেঁ ফেরে অরণ্য। ইউনিভার্সিটি থেকে বের হবার ঠিক এক বছরের মাথায় সমাবর্তনের আয়োজন করে কর্তৃপক্ষ। পড়ালেখা শেষ করে তার ক্লাশমেটদের অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। ঢাকা শহরে যারা থাকে ব্যস্ততায় তাদের সাথেও দেখা হয়ে উঠেনা। চলতি পথে রাস্তায় বা বাসের ভেতরে কোথাও দেখা হলে কৌশল বিনিময় করতে করতেই যে যার কাজে ছুটে চলে। সময় করে কয়েকজনে মিলে একত্রে বসা হয়ে উঠেনা। সবার অবসর সময় গুলো একত্রে ধরা দেয়না। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অনেক পরিচিত মুখ চোখে পড়ে অরণ্যর। দীর্ঘ দিন পরে একত্রে জড়ো হওয়ার আনন্দে অনেকেই বিভোর হয়ে পড়ে তুমুল আড্ডায়। কেউবা শেয়ার করে নিজ কর্মক্ষেত্রের কথা।কত হাসি-আনন্দ;দু:খ-বেদনার কথা মালা সেসব।মনযোগ সহকারে শুনে সবাই। প্রিয় শিক্ষকদের সাথেও দেখা হয়। তারা আগ্রহ ভরে জানতে চান কে কোথায় কি করছে। যখন শুনে চাকুরী করছে, ভাল অবস্থায় আছে তাদের মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠে। নানা উপদেশ দেন তাঁরা। কয় বন্ধুতে মিলে ক্যাম্পাসের এক পাশে গল্প করছিল অরণ্য। তার প্রিয় এক শিক্ষক পাশ দিয়ে চলার সময়ে ছুটে যায় তাঁর কাছে। অরণ্যকে দেখে তিনি খুব খুশি হন।কৌশল জানতে চান । কি করছে;কোথায় আছে সব জানতে চান।এক সময় তিনি তারঁ স্ত্রীর সাথে অরণ্যকে পরিচয় করিয়ে দেন। তোমাকে বলতামনা আমার একজন প্রিয় ছাত্র আছে যে খুব ভাল ছবি তুলে? এ হল সেই অরণ্য। আজ কয়েকটা ছবি তুলে নিও তাকে দিয়ে। আর অরণ্য এ হল আমার মানে তোমার ভাবী। মানুষটিকে দেখে অরণ্য বাকহীন মানুষের মত তাকিয় থাকে। এ যে সেই মানুষ যাকে সে খুজেঁ ফেরে।

বৃষ্টি ভেজা স্বপ্ন

Posted by zhsoykot On বুধবার, ২৮ জুলাই, ২০১০ 2 মন্তব্য(গুলি)

ফের বৃষ্টিতে ভিজে বাসে উঠতে খানিকটা ভিজে যাই। সামনে থেকে পেছনে চোখ বুলাই। খালি কোন সিট চোখে পড়েনা। ফের অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে নজর দিই। মাঝ বরাবর একটা সিট খালি মনে হল। পাশে গিয়ে দেখি একটি মেয়ের পাশের সিট খালি। দূরের জার্নি ,বসার একটা ব্যবস্থা করতে হবে ভেবে প্রশ্ন ছুড়ি- আপনার সাথে কেউ আছেন?
জ্বীনা।
আমি বসি?
হ্যা বসুন।
ধন্যবাদ।
পরণের কাপড় ভিজা তাই যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সিটের বাইরের দিকে পা দিয়ে বসি।আমার পরে আরো কয়জন বাসে উঠে কন্টাক্টর সহ তাদের কেউ কেউ সামনে পেছনে যাওয়াতে আমাকে বারবার নড়ে চড়ে বসতে হয়। বার বার আমাকে এমন করতে দেখে বলে- আপনি সোজা হয়ে বসুন। আরেকটু চেপে জানলার পাশে বসার ব্যর্থ চেষ্টা করেন তিনি।
না না ঠিক আছে আমার পরণের কাপড় খানিকটা ভেজা কিনা তাই।

বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। রাস্তা খারাপ। বাস চলার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নৌকায় করে যাচ্ছি। বাস যখন বড় গর্তে পড়ে পাশের যাত্রীর গায়ে হেল পড়া ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। কখনো আমি পাশের যাত্রীর উপর গিয়ে পড়ি আবার কখনো উনি।

বৃষ্টি থামেনা, রাস্তার অবস্থাও একই। চলার গতি বলতে খুড়িয়ে চলা।।
বাসের গড়াগড়িতে উপর থেকে একটা ব্যাগ আমার পায়ের উপর পড়ে।হালকা ব্যাগ। মনে হল কিছু কাপড় চোপড় হবে। ব্যাগটা পড়ার পরই পাশের যাত্রী সরি বলে কেঁপে উঠে। ধারণা হয়তোবা ব্যাথা পেয়েছি। আমি তাৎক্ষণিক জবাব দিই না সমস্যা নেই। আমি উঠে ফের সেটা যথাস্থানে রাখি। বসতে গিয়ে দুজনার চোখে চোখ পড়ে। খানিকাটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি উভয়েই। সেটাকে সামলে নিতে জানতে চাই
আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
কুমিল্লায়। আপনি?
আমিও ।

কিছুটা ক্লান্ত মনে হল তাকে। দিনের ক্লান্তি শেষে হয়তো বাসায় ফিরছে।আর কথা বাড়াতে চাইনি। কথা তুলে সে ই।
আপনার বাসা বুঝি কুমিল্লায়?
না, এক বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছি।
আমি যাচ্ছি এক কাজিনের বিয়েতে।
তাই ? শহরেই নাকি?
জ্বী।
একটা ভাঙ্গা ব্রিজের কাছে বাস থেমে পড়ে। অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে । ঘোর অন্ধকারে কিছুই দেখা যায়না। মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছি কখনো না আবার বাস রাস্তা ছেড়ে খাদে পড়ে যায়।

পাশের যাত্রী তার হাত ব্যাগে কী যেন খুঁজে। ব্যাগের এপাশ ওপাশ তন্ন তন্ন করেও কাঙ্খিত বস্তুটি খুজে পায়না। তাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হয়। জানতে চাই- কোন সমস্যা হল নাকি?
না, মানে মোবাইলটা খুজেঁ পাচ্ছিনা।
আছে হয়তোবা কোন ফাঁক ফোকরে।
না ব্যাগে নেই দেখছি।
কোথাও পড়ে যায়নি তো? কিংবা বাসায় রেখে এসেছেন কিনা।
ঠিক মনে পড়ছেনা।
আমার মোবাইলটা বাড়িয়ে দিলাম- একটা ফোন করে দেখুন কি অবস্থা।
প্রথম দুইবার রিং হলেও কেউ ধরেনি। তৃতীয় কলের সময় একজন রিসিভ করে জানায় যে মোবাইল বাসায় রেখে এসেছে। তখনই মনে পড়ে কলেজ থেকে ফিরে মোবাইল চার্জে দিয়েছিল। তাড়াহুড়া করে বের হবার সময়ে আর মনে ছিলনা।

প্রায় আধ ঘন্টা সময় ব্যয় করে ভাঙা ব্রীজটা পেরোয়। আবার খুড়িয়ে চলতে শুরু করে বাস । মাঝে মাঝে বাসের ঝাকুনিতে পাশের যাত্রী আমার গায়ে হেলে পড়ে। রাত ঘনিয়ে আসার সাথে তার ক্লান্তিও ভর করেছে শরীরে। হেলে পড়াটা তার কাছে খানিকটা বিব্রতকর লাগছে। বিষয়টি আচঁ করতে পেরে তাকে স্বাভাবিক করতে জানতে চাই
আপনি মনে হয় বেশ ক্লান্ত।
হ্যা সকাল আটটায় বাসা থেকে বেরিয়েছি। ক্লাশ করেছি চারটা। শেষ বিকেলে একটা এসাইনমেন্ট ছিল। বাসায় ফিরে কিছু নাকে মুখে গুজে রওয়ানা দিতে হয়েছে।বাস স্ট্যান্ড এ পৌছতেই সন্ধে হয়ে আসে। এত ধকলের পর যাবার ইচ্ছে ছিলনা। কয়দিন বাদে পরীক্ষা।কিন্তু বারবার সে ফোন করছে,তাই....
আমি যার বিয়েতে যাচ্ছি অনেক দিন ধরে আমাদের দেখা নেই। কেবল মোবাইলে যোগাযোগ। বলেছে আমি না গেলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।
তাই নাকি? তাহলেতো আপনারা দারুণ বন্ধু!
তা বলেত পারেন।


আমার মোবাইলটা বেজে উঠে। ওই প্রান্ত থেকে জানতে চায় আমি কোথায় আছি। উত্তর দিই বাসে । কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পৌছে যাব। কলটা শেষ হতেই পাশের জন অনুরোধ করেন
মোবাইলটা একটু দিবেন প্লিজ- কাজিনটা হয়তো আমাকে খুঁজ করছে না পেয়ে চিন্তা করবে, তাকে একটু জানিয়ে দিই।

সাগ্রহে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিই।

প্রথমবার রিং হতেই অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে- মৃদুল কোন সমস্যা?
আমি মৃদুল না,অনন্যা।
অনন্যা?
আমার পাশে একজন আছেন উনার কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে নিয়েছে তোমাকে জানানোর জন্য।
এটা তো মৃদুলের নম্বর। একটু আগে কথা হয়েছে আমার সাথে। তুই কি তার সাথে নাকি?
হ্যা।
শোন ও আমার বন্ধু। কোন চিন্তা করিসনা। রাখি।
ফোনটা আমাকে ফেরত দিতে জানতে চায়- আপনি চৈতালির বিয়েতে যাচ্ছেন?
আমি একটু অবাক হলাম। জ্বী, আপনি চেনেন নাকি?
আমিতো তার বিয়েতই যাচ্ছি! কিভাবে মিলে গেল! ভালই হল। রাত হয়ে যাওয়াতে আমি চিন্তিত ছিলাম।
এবার অনন্যা কিছুটা স্বাচ্ছন্দবোধ করে।আলাপে মত্ত হতে চায় কিন্তু ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসে। জোর করে চোখ খুলে রাখার ব্যর্থ চেস্টা করে। পরে আলাপ করা যাবে আপনি একটু বিশ্রাম নিন বলে কথার ইতি টানি।

ক্লান্তি আর বাসের ঝাকুনিতে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় অনন্যা। বাসের প্রবল ঝাকুনিতে জেগে থেকেই শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা দায়; ঘুমিয়েতো সেটা অবান্তর। ঘুমের ঘোরে অনন্যার মাথা এসে ঠেকে আমার ঘাড়ে।
বাসের ঝাকুনিতে মাঝে মাঝে আমার কাধ ছেড়ে কখনো জানলার দিকে হেলে পড়ে ফের আমার কাধেঁ। হঠাৎ প্রচন্ড এক ঝাকুনির চোটে অনন্যা আমার কোলে হেলে পড়ে।
রাত গভীর হয়;পাল্লা দিয়ে বাড়ে বৃষ্টি। ভাঙ্গা রাস্তা আর বৃষ্টির কারণে দুই ঘন্টা লেটে আমরা কুমিল্লায় পৌছি।

অন্যানা ঘুম থেকে জেগে দেখে আমার বাহুডুরে আবদ্ধ। ধড়ফর করে উঠে বসে। লজ্জায় কুকরে যাবার মত অবস্থা। কেমন করতে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বলি-বিব্রত হবার কিছু নেই, আপনার ঘুম ব্যঘাত ঘটবে বলে জাগাইনি। চলুন নামার সময় সময় হয়েছে।

রাত তখন এগারটা প্রায়। বিদ্যুৎ বিহীন শহরে নিকষ অন্ধকার। একটা রিক্সায় উঠি দু’জন। বাসের রেশটা তার মধ্যে অনুভব করি তখনও। জড়োসড়ো হয়ে বসে । আমি ফের........।

আমি বাসা চিনিনা। অনন্যা একবার এসেছিল অনেক পূর্বে। ফোন দিই লোকেশন জানার জন্য। ওই প্রান্ত থেকে হ্যালো বলতেই চার্জের অভাবে মোবাইল খানা বন্ধ হয়ে যায়। পড়ি মহা চিন্তায়। নতুন ড্রাইভার। অন্ধকারে পথ চলতে গিয়ে সে ঝাউতলার পরিবর্তে বাদুরতলায় চলে যায়। এ যেন মড়ার উপর খড়ার ঘা! অনেক কষ্টে একজনার সহায়তায় সঠিক রাস্তার সন্ধান পাই।

রাজ্যের ক্লান্তি শরীরে নিয়ে বাসায় পৌছি রাত একটায়। হাতমুখ ধুয়ে হালকা মুখে দিয়ে হারিয়ে যাই ঘুমের রাজ্যে।


বাসে উঠার পূর্বে আধঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম কথা প্রসঙ্গে জেনেছিল অনন্যা। অনেক বেলা হবার পরেও ঘুম ভাঙছেনা দেখে জ্বর হল কিনা সে শংকায় আমার কপালে হাত বুলায়। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় আমার। আবারো বিব্রত হয় অনন্যা। মাথা নিচু করে চলে যাবার সময় তাকে থামাই। কী ব্যাপার কিছু বলতে এসেছিলেন নাকি? বসুন না।
থতমত খেয়ে যায় - না না আমি ভাবলাম কাল বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে কোন সমস্যা হল কিনা।
অভয় দিয়ে বলি বৃষ্টিতে ভিজলে আমার কোন সমস্যা হয়না।
অন্যনা চলে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন, নাস্তা রেডি।

খাবার টেবিলে বসেই চৈতালি খোচাটা দেয়- কত মেয়ে পিছনে ঘুর ঘুর করেছে কারোর দিকে যে ফিরেও তাকায়নি সে কিনা প্রথম দর্শনেই কোলে.......
লজ্জায় রাঙা লাল হয়ে অনন্যা মাথা নিচু করে উঠতে উঠতে বলে কাজটা তুমি ভাল করনি।
পেছন থেকে ওড়নার আচঁল ধরে টান দিয়ে তাকে থামায় চৈতালি। আরে বস, লজ্জার কি হল। দেখতে হবেনা কাজিনটা কার? দেখতে যেমন মনটাও তেমন আমিও মৃদুলের জন্য এমন একটা মেয়েই খুঁজছিলাম। আচ্ছা মৃদুল অনন্যাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
দৌড় দিয়ে রোম ছেড়ে চলে যায় অনন্যা।

বাড়ির কারোরই কোন ফুসরত নেই। কেউ ব্যস্ত আগত অতিথিদের বরণ করা নিয়ে; প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র সব কেনা হল কিনা কেউ খবর নিচ্ছে, কেউ আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। আমি ঘুরে ঘুরে সব দেখি।

দোতলা থেকে নামার পথে সিড়িতে দেখা মেলে অনন্যার। হাতে শরবতের গ্লাস। বুঝতে পারি আপ্যায়নে মশগুল। কাছাকাছি আসতেই মুখোমুখি দাড়াই দু’জন। নির্বাক কিছুটা সময় পেরিয়ে যায়। কারোর চোখেরই পলক পড়েনা। কেউ একজন পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সম্বিৎ ফেরে । কি বলব কিছু ভাবার পূর্বেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- কেমন আছেন?
ভাল, আপনি কেমন আছেন?
ভাল।
অনন্যা তার শরবতের গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়।আমার জন্য নয় তাই নিতে সংকোচ বোধ করে বলি- ধন্যবাদ, যার জন্য নিচ্ছিলেন তিনি অপেক্ষা করছেন ,আপনি যান।
না আপনি নেন আমি আবার নিয়ে আসব।
গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকেই শেষ করে ফেলি। আমার শরবত পান দেখে প্রশ্ন করে -আরেক গ্লাস এনে দিব?
না না আর লাগবেনা-গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে।

দুই জোড়া চোখ ছিল চোখের পানে নিবিষ্ট। আমি গ্লাস অনন্যার হাতে দিয়ে ছিলাম কিনা কিংবা অন্যনা সে গ্লাস ধরেছিল কিনা সে খেয়াল কারোর ছিলনা। খেয়াল হয় গ্লাস ভাঙ্গার আওয়াজ শুনে।

কমিউনিটি সেন্টার থেকে চলে আসি।চৈতালিদের বাসায় আর যাওয়া হয়না।

ঠিকানা বদলের মত চৈতালি তার ফোন নম্বরটাও বদলে ফেলে। একদিন জানিয়েছিল ফোন করে। বে খেয়ালে সেটা স্মৃতিতে ধরে রাখা হয়নি। স্ব-স্ব ব্যস্ততায় আমাদের যোগাযোগটা তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

সময় বয়ে চলে নিজস্ব গতিতে।তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলি আমিও। পড়াশুনা শেষে একটা চাকুরী ও জুটে যায়।

মা বাবার আশীর্বাদ নিয়ে চাকুরীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে এক বিকেলে রওয়ানা হই। কাউন্টারে বসে বাসের অপেক্ষা করি। বাস আসেনা। আমি প্রতীক্ষা করতে থাকি। সন্ধা ঘনিয়ে আসে। আচমকা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। বৃষ্টির ঝটকা বাড়তেই থাকে।


ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুই ছুই। একটা বাস এসে কাউন্টারের সামনে দাড়ায়। বৃষ্টির কারণে নেমে যাওয়া যাত্রীরা কাউন্টারের ভেতরে আসতে থাকে। যাত্রীদের ভিড়ে আমার চোখ একজনার দিকে আটকে যায়। আমার দেখার ভুল কিনা তা যখন ভাবছি দেখি আমার দিকেই আসছে।

মৃদুল সাহেব যে, কেমন আছেন?অনন্যা আমার সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন করে।
আমি উঠে দাড়াই। ভাল , আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভাল।
দুইটা লাগেজ হাতে একজন সুদর্শন যুবক তার পাশে এসে দাড়ায়। পরিচয় করিয়ে দেয় আমার......।
তার সাথে করমর্দন করি। জায়গা করে দিয়ে বসতে অনুরোধ করি।
বৃষ্টি খানিকটা কমতে শুরু করেছে। অনন্যা বসে। তার স্বামী কিছু কেনা-কাটার জন্য বাইরে বেরিয়ে যায়।

কথা শুরু করে অনন্যা। বিয়ে বাড়িতে ব্যস্ততায় আর কোন কথা হয়নি। পরে যখন খবর নিলাম দেখি আপনি নেই। আপনার ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বর কিছুই নেয়া হয়নি। সেখান থেকে ফেরার পর আপনার কোন খবর পাইনি। অনেকবার আপনার কথা মনে পড়েছে। পরীক্ষার ধকলে কেটে যায় কয়েক মাস।

পরীক্ষা শেষে আপনার সাথে যোগাযোগের নিমিত্তে ছুটে যাই চৈতালির কাছে। ততদিনে চৈতালি স্বামীর সাথে পরবাসী হয়ে গেছে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি। তারপরও যে চেষ্টা করিনি তা নয় কিন্তু আপনার সন্ধান মেলেনি।

স্কুল কলেজ,বিম্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। বন্ধুর সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিলনা। কাউকেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখিনি। আমার জীবনের এক বিশেষ মুহূর্তে বিশেষভাবে আপনাকে পেয়েছিলাম। ভেছিলাম বাকী জীবনটা আপনার সাথেই কাটিয়ে দিব। আপনার জন্য প্রতীক্ষাও করেছি। কিন্তু নিয়তি এক সুতোয় আমাদের বাধতে চায়নি।

অনন্যার কথার মাঝে আমি হারিয়ে যাই। কি ছিল আমাদের সম্পর্ক? দেড় বছর পূর্বে অনান্যার সাথে প্রথম দেখা । তারপর? অনন্যা কি ছিল আমার মনে? একাবারও কি তার খোঁজ নিয়েছি? আজ এ ভাবনা মনে এনে কি হবে? প্রশ্নের উত্তরইবা খুঁজে কি লাভ?

থাক এসব কথা। আপনার কথা বলুন।

ভাবনার ঘোর ভাঙে তার কথায়।
কাউন্টারের এজন দেখি আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। স্যার, আপনার বাস চলে এসেছে।

আমি বাসে উঠে পড়ি ।

শৈশবের বৃষ্টি ও বর্ষা কাহন

Posted by zhsoykot On বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০১০ 2 মন্তব্য(গুলি)

স্লামালেকুম। আসতে পারি?
রিসিপশনে বসা অনুর্ধ পঁচিশ বছরের রমনী আহ্বান জানায়,'হাঁ আসুন'।
আমীর উদ্দিন তার কাছে গিয়ে দাড়ায়।তিনি আসার হেতু জানতে চান। কন্ঠে বলে'পত্রিকায় আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি'। তার জড়তা কাটতে চায়না।
ও হ্যাঁ,এটা শিক্ষিত বেকারদের জন্য আমাদের একটি স্পেশাল কোর্স; তিনমাসের কোর্স। প্রশিক্ষণ দেয়া হবে পাশাপাশি থাকা খাওয়ার জন্য প্রথম মাসে ২০০০,দ্বিতীয় মাসে ৩০০০,তৃতীয় মাসে ৪০০০ টাকা করে দেয়া হবে। পরবর্তীতে চাকুরী হয়ে গেলে মাসে ৫০০০ টাকা সেলারি পাবেন। এক কাজ করুন ২০০ টাকা আর এককপি ছবি দেন,আমি একটা ফরম দিচ্ছি;এখানে একটা স্বাক্ষর করেন। এক ঘন্টা পরে এসে খোঁজ নিবেন।
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে আমীর উদ্দিন,চাকুরী তাহলে একটা জুটে গেল! ছবি , টাকা আর একটা ফরমে সই দিয়ে বেরিয়ে আসে।
কারওয়ান বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে সোনারগাও হোটেলের সামনে এসে দাড়ায়। নিবিষ্ট চিত্তে খুটিয়ে দেখতে থাকে বিল্ডিংটাকে। সে শুনেছে এখানে খেতে গেলে অনেক টাকা বিল দেয়া লাগে। ভাবে চাকুরীটা হয়ে গেলে এদিন এই হোটেলে এসে....। পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে হেটে এফডিসির সামনে আসে।অনেক লোকের জটলা দেখে সেও দাড়ায়।কতক্ষণ পর পর গাড়ি ভিতরে যায় আবার বের হয়।বেশিরভাগ গাড়িই কাল গ্লাসের; ভেতরে কিছুই দেখা যায়না।

পেছনে সরানোর উসিলায় আচমকা এক লোক তাকে সম্মুখ দিক থেকে ধাক্কা দেয়।সময় পেরিযে যাচ্ছে ভেবে আর দাড়ায়না। কারওয়ান বাজারে চলে আসে। এখানে এসে জানতে পারে তার চাকুরী হবে,ভর্তি ফি বাবদ তিন হাজার টাকা দিতে হবে।
মাত্র কয়েশ টাকা আছে তার কাছে।বিনীত কন্ঠে শূধায়'আমার কাছে টাকা নেই,আপনারা প্রশিক্ষণ ভাতা বাবদ যে টাকা দেবেন তার থেকে যদি....।'এটা আমাদের ফি প্রশিক্ষণে যা পাবেন তার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক আছে ,আপনি বাড়ি চলে যান , যেদিন টাকা নিয়ে আসবেন সেদিনই আপনাকে নিয়োগ দিয়ে দিব।

আমীরউদ্দিন বেরিয়ে আসে। ফরম বাবদ যে টাকাটা দিয়েছিল তা ফেরত চাওয়ার ভাষা তার মুখ দিয়ে বের হয়নি। একটি রেস্টুরেন্টএ গিয়ে কিছু খেয়ে বিল দেবার সময় দেখে বুক পকেটে থাকা টাকা গুলো নেই! বুঝতে বাকী থাকেনা এফডিসির সামনের ধাক্কাটা টাকা নেওয়ার মূল হোতা।
ইস্কাটন রোডে আসে। অনেক খুজেঁ একটি ঔষধ কোম্পানীর অফিস বের করে সেখানে গিয়ে দেখে ১০০ টাকা দিয়ে নাম নিবন্ধন করতে হবে।দুটি প্রতিষ্ঠানকে একই মনে করে বাড়ি চলে আসে।

আমীর উদ্দিন বিএ পাশ করেছে দুই বছর হতে চলল। নিম্মবিত্ত পরিবারের ছেলে সে। বাবার নিজের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে।অনেক কষ্ট হয়েছে তাকে পড়াতে। তার জন্য ছোট বোনটাকে বেশি পড়াতে পারেনি। অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হয়েছে।
চাকুরীর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে আমীর উদ্দিন। নিয়মিত পত্রিকা পড়তে পারেনা। শুক্রবারে কেবল পত্রিকা রাখে। মাঝে মাঝে কলেজে একপাক ঘুরে আসে কেবল পত্রিকায় নতুন কোন চাকুরীর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে কিনা দেখার জন্য। প্রায়ই আশাহত হয়ে ফিরতে হয়,আবার কোন দিন কলেজে গিয়ে দেখে বিজ্ঞপ্তির অংশটুকু কে বা কারা কেটে নিয়ে গেছে।

চাকুরী দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন ভিন্নতা দেখেনা সে। সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন জমা নেয়ার আগেই কিছু টাকা নিয়ে নেয় আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নেয় ভিন্ন ছলে। কোনটার প্রতিই তার আস্থা নেই।তবু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখলে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে। তার যে একটা চাকুরী দরকার।
একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিতে যায়।প্রবেশপত্রে সেদিনই ফলাফল দেয়ার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে জানাবে বলে নোটিশ দিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন কোন পত্রের দেখা মেলেনা।

ছয় মাস পর ভাইভা পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এবার হয়তোবা তার চাকুরীটা হয়ে যাবে ভরসায় ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে গিয়ে দেখে যারা রিটেন পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের সবাইকেই ডেকেছে। এ প্রহসনের মানে সে বুঝেনা।সরকারী চাকুরীর প্রতি আস্হা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।

নতুন একটি ঔষধ কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী হয়ে একদিন আবেদন নিয়ে হাজির হয় নোয়াখালী। ট্রেন থেকে নামার সময় ঘটে এক ভয়ানক কান্ড। টিউশনির দেড়শ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। সাথে পকেট কোনে আরো দুই টাকা। ত্রিশ টাকায় টিকেট কাটে। নোয়াখালী স্টেশনে গাড়ী থামার পর দেখে ফ্লাটফর্মের দিকের দরজাটা বন্ধ।বার কয়েক চেষ্টা করে খুলতে না পেরে পরের কামরা দিয়ে নামার জন্য পা বাড়ায়। যেই নামতে যাবে, মোবাইল কোর্টের লোকজন তাকে আটক করে। প্রথম শ্রেনীতে উঠার দায়ে ১২০ টাকা আদায় করে নেয়। হতভম্ব হয়ে স্টেশন ত্যাগ করে অনেক খোঁজাখুজি করে কাঙ্খিত ঠিকানায় গিয়ে দেখে তা বন্ধ। সেদিন রোজা শেষে দুই টাকার মুড়ি কিনে ইফতারী করে যখন বাড়ি ফিরে রাত অনেক হয়ে যায়।

একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। ফের আবেদন করে। অনেক দিন পার হয় ইন্টারভিউ কার্ড আসেনা। আসেনা তো আসেনা।এরি মাঝে আরেকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে। লোক মুখে শুনেছে এই চাকুরী পেতে হলে বড় অংকের টাকা দিতে হবে। টাকা দেয়ার সামর্থ্য তার বাবার নেই। তবু আশায় থাকে।

গ্রামের রাস্তায় বের হলে লোকজন নানা বিরক্তিকর মন্তব্য করে।"দেখ ছেলেটা কত লেখা পড়া করেছে,চাকুরী নাই;আরে এ দেশে মামা দুলাভাই না থাকলে কি আর চাকুরী মেলে? এখন ঘুর। না হালের হয়েছে না হয়েছে জোয়ালের। বাপটা খেটে মরছে উনি নবাবজাদা হয়ে ঘুরে বেড়ান।" এসব শুনতে আর ভাল লাগেনা তাই বাড়ি থেকে বের হওয়া অনেকটা বন্ধ করে দেয়।

একদিন পত্রিকার পাতায় একটি খরব দেখে চোখ আটকে যায় আমীর উদ্দিনের। একটি বেসরকারী ফাউন্ডেশন এইচ এস সি পাশ থেকে শুরু করে এম এ পাশ বেকারদের জন্য বিশেষ এক কর্মসূচী হাতে নিয়েছ। তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করার পাশাপাশি পড়াশোনাও করা যাবে। তাদের পলিসি দেখে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে।

তিনটা ইন্টারভিউ কার্ড একসাথে আসে। বুধবার দিন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাতকার;বৃহস্পতিবার দীর্ঘদিন পূর্বে আবেদন করা প্রতিষ্ঠানের ইন্টারভিউ চট্টগামে আর শুক্রবারে অন্যটার পরীক্ষা কুমিল্লায়। নিজের টিউশনির কিছু টাকা এবং মায়ের কাছ থেকে কিছু নিয়ে রওয়ানা দেয়।
ঢাকায় সাক্ষাতকারের সময় ৪ টা এক ঘন্টা পূর্বেই সেখানে পৌছে। প্রতীক্ষার শেষ হয় সন্ধে সাতটায়। ফাউন্ডেশন প্রধান নাকি অন্য একটি মিটিংয়ে ছিলেন।আমীর উদ্দিনের সাক্ষাতকার শেষে তারা গ্রিন সিগনাল দিয়ে চলে যেতে বলেন। রাতের ট্রেনে চট্ট্রগ্রাম রওয়ানা দেয়।সারারাত না ঘুমিয়ে গাধাগাধি করে বসে থেকে সকালে পৌছে। অচেনা জায়গা চিনতে অনেক কষ্ট হয়। পকেটে অর্থের অভাবে পা দু’টোকেই বাহন বানিয়ে পথ খুঁজতে হয়। দুই ঘন্টা দেরিতে শুরু হওয়া পরীক্ষা শেষ হয় বিকেল ৪ টায়। ফেরত ট্রেন ধরতে হেঁটে পাহাড়তলী আসে। ট্রেন এখানে থামেনা শুনে আবার হেঁটে র্ওয়না দেয় বটতলী স্টেশনে।

রাত আটটায় একপ্রকার যুদ্ধকরে মেইল ট্রেনে উঠে। জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় এখানে।কিছু দালাল গোছের লোক আগেই ট্রেনে উঠে সিট দখল করে বসে আছে।যাত্রীদের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে। পুলিশও কম যায়না। তার ও টাকার বিনিময়ে একটি বগিতে লোক তুলছে। দুই দিনের কর্মক্লাতিতে ট্রেনে উঠার পরই ঘুমে চোখ বুঝে আসে। কিন্তু ঘুমাতে পারেনা যদি ট্রেন কুমিল্লা ছেড়ে চলে যায়। রাত একটায় ট্রেন থেকে নামে। চোখের পাশাপাশি শরীরেও ক্লান্তি ঝেঁকে বসে। একটি বিশ্রাম কক্ষে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুম দিতেই এক পুলিশ ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। বসার সিটটাও হারায়।

ভারসাসম্যহীন শরীরে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে রাতাটা কাটিয়ে সকালে বৃষ্টিতে কাকা ভেজা হয়ে এক স্কুলে হাজির হয়। তার মত হাজার হাজার চাকুরী প্রার্থী পূর্বেই এসে বসে আছে। মাত্র কয়েকটা পোস্টের জন্য এত প্রার্থী!কার হবে চাকুরী ভেবে পায়না। পরীক্ষা শেষে বাড়ী চলে আসে।

আমীর উদ্দিন মনে মনে আশাবাদী হয়ে উঠে,এবার নিশ্চয় একটা চাকুরী হবে। আশাটাকে একধাপ এগিয়ে দিতে সেই বেসরকারী ফাউন্ডেশন থেকে চিঠি আসে। সেখানে উল্লেখ আছে সে নিবর্বাচিত হয়েছে। সকল মূল সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে বলেছে তারা।

সেদিন শুক্রবার। সকালে কাঙ্খিত ঠিকানায় হাজির হয় ।পাঁচজন মানুষ তাকে নানা প্রশ্ন করে। শেষে তারা নিশ্চিত ভাবে জানায় সে নির্বাচিত হয়েছে। চাকুরী করবে পাশাপাশি এম বিএ পড়বে। বেতন হিসেবে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হবে। সেখান থেকে পড়াশোনার ফি হিসেবে আড়াইহাজার টাকা কেটে নেয়া হবে।দিনের প্রথম দিকে পড়াশোনা করবে বিকেলে করবে চাকুরী। আগামীকালই সে যোগদান করতে পারবে।এ জন্য তাকে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে।

টাকার কথা শুনে ব্যর্থ মনোরথে অফিস ত্যাগ করে।

একপশলা বৃষ্টি হয়।রাস্তা ঘাটেও পানি জমে।

পার্কের এক কোনে একটি বেঞ্চে বসে আমীর উদ্দিন। আজ বড় আশা নিয়ে এসেছিল। এখন আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। কেন লেখাপড়া করেছিল ভেবে পাচ্ছেনা। ছোট বেলায় বাবার সাথে কাজে লেগে গেলেই বরং ভাল হত। বাবার উপর ধকলটা কম পড়ত।নানা সব চিন্তা মাথায় ভর করে।
তার সামনে বেশ কিছু পানি জমে আছে।মৃদু বাতাসে পানিতে ছোট ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন ছোট্ট এক নদী। পানি দেখে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। বর্ষাকালে বৃষ্টির পর যখ তাদের উঠানে পানি জমত কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসাত।বৃষ্টির পানির স্রোতে নৌকাগুলো উঠানের এ মাথা থেকে ওই মাথায় ভেসে বেড়াত। সে স্মৃতি মাথা চারা দিয়ে উঠে। আমীর উদ্দিন হাতের ফাইলটা খুলে একটা করে সার্টিফিকেট বের করে আর একেকটা নৌকা তৈরি করে।একে একে সব গুলো পানিতে ভাসিয়ে দেয়।মৃদু বাতাসের পরশে নৌকাগুলো ধীর গতিতে দূরে চলে যেতে থাকে। আমীর উদ্দিন দেখতে পায় তার মনের জমাট বাধা কষ্টের পাহাড় নিয়ে নৌকা গুলো চলে যাচ্ছে।



স্লামালেকুম। আসতে পারি?
রিসিপশনে বসা অনুর্ধ পঁচিশ বছরের রমনী আহ্বান জানায়,'হাঁ আসুন'।
আমীর উদ্দিন তার কাছে গিয়ে দাড়ায়।তিনি আসার হেতু জানতে চান। কন্ঠে বলে'পত্রিকায় আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি'। তার জড়তা কাটতে চায়না।
ও হ্যাঁ,এটা শিক্ষিত বেকারদের জন্য আমাদের একটি স্পেশাল কোর্স; তিনমাসের কোর্স। প্রশিক্ষণ দেয়া হবে পাশাপাশি থাকা খাওয়ার জন্য প্রথম মাসে ২০০০,দ্বিতীয় মাসে ৩০০০,তৃতীয় মাসে ৪০০০ টাকা করে দেয়া হবে। পরবর্তীতে চাকুরী হয়ে গেলে মাসে ৫০০০ টাকা সেলারি পাবেন। এক কাজ করুন ২০০ টাকা আর এককপি ছবি দেন,আমি একটা ফরম দিচ্ছি;এখানে একটা স্বাক্ষর করেন। এক ঘন্টা পরে এসে খোঁজ নিবেন।
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে আমীর উদ্দিন,চাকুরী তাহলে একটা জুটে গেল! ছবি , টাকা আর একটা ফরমে সই দিয়ে বেরিয়ে আসে।
কারওয়ান বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে সোনারগাও হোটেলের সামনে এসে দাড়ায়। নিবিষ্ট চিত্তে খুটিয়ে দেখতে থাকে বিল্ডিংটাকে।সে শুনেছে এখানে খেতে গেলে অনেক টাকা বিল দেয়া লাগে।ভাবে চাকুরীটা হয়ে গেলে এদিন এই হোটেলে এসে....। পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে হেটে এফডিসির সামনে আসে।অনেক লোকের জটলা দেখে সেও দাড়ায়।কতক্ষণ পর পর গাড়ি ভিতরে যায় আবার বের হয়।বেশিরভাগ গাড়িই কাল গ্লাসের; ভেতরে কিছুই দেখা যায়না।

পেছনে সরানোর উসিলায় আচমকা এক লোক তাকে সম্মুখ দিক থেকে ধাক্কা দেয়।সময় পেরিযে যাচ্ছে ভেবে আর দাড়ায়না। কারওয়ান বাজারে চলে আসে। এখানে এসে জানতে পারে তার চাকুরী হবে,ভর্তি ফি বাবদ তিন হাজার টাকা দিতে হবে।
মাত্র কয়েশ টাকা আছে তার কাছে।বিনীত কন্ঠে শূধায়'আমার কাছে টাকা নেই,আপনারা প্রশিক্ষণ ভাতা বাবদ যে টাকা দেবেন তার থেকে যদি....।'এটা আমাদের ফি প্রশিক্ষণে যা পাবেন তার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক আছে ,আপনি বাড়ি চলে যান , যেদিন টাকা নিয়ে আসবেন সেদিনই আপনাকে নিয়োগ দিয়ে দিব।

আমীরউদ্দিন বেরিয়ে আসে। ফরম বাবদ যে টাকাটা দিয়েছিল তা ফেরত চাওয়ার ভাষা তার মুখ দিয়ে বের হয়নি। একটি রেস্টুরেন্টএ গিয়ে কিছু খেয়ে বিল দেবার সময় দেখে বুক পকেটে থাকা টাকা গুলো নেই! বুঝতে বাকী থাকেনা এফডিসির সামনের ধাক্কাটা টাকা নেওয়ার মূল হোতা।
ইস্কাটন রোডে আসে। অনেক খুজেঁ একটি ঔষধ কোম্পানীর অফিস বের করে সেখানে গিয়ে দেখে ১০০ টাকা দিয়ে নাম নিবন্ধন করতে হবে।দুটি প্রতিষ্ঠানকে একই মনে করে বাড়ি চলে আসে।

আমীর উদ্দিন বিএ পাশ করেছে দুই বছর হতে চলল। নিম্মবিত্ত পরিবারের ছেলে সে। বাবার নিজের জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে।অনেক কষ্ট হয়েছে তাকে পড়াতে। তার জন্য ছোট বোনটাকে বেশি পড়াতে পারেনি। অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হয়েছে।
চাকুরীর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে আমীর উদ্দিন। নিয়মিত পত্রিকা পড়তে পারেনা। শুক্রবারে কেবল পত্রিকা রাখে। মাঝে মাঝে কলেজে একপাক ঘুরে আসে কেবল পত্রিকায় নতুন কোন চাকুরীর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে কিনা দেখার জন্য। প্রায়ই আশাহত হয়ে ফিরতে হয়,আবার কোন দিন কলেজে গিয়ে দেখে বিজ্ঞপ্তির অংশটুকু কে বা কারা কেটে নিয়ে গেছে।

চাকুরী দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন ভিন্নতা দেখেনা সে। সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন জমা নেয়ার আগেই কিছু টাকা নিয়ে নেয় আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নেয় ভিন্ন ছলে। কোনটার প্রতিই তার আস্থা নেই।তবু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখলে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে। তার যে একটা চাকুরী দরকার।
একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিতে যায়।প্রবেশপত্রে সেদিনই ফলাফল দেয়ার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে জানাবে বলে নোটিশ দিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন কোন পত্রের দেখা মেলেনা।

ছয় মাস পর ভাইভা পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এবার হয়তোবা তার চাকুরীটা হয়ে যাবে ভরসায় ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে গিয়ে দেখে যারা রিটেন পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের সবাইকেই ডেকেছে। এ প্রহসনের মানে সে বুঝেনা।সরকারী চাকুরীর প্রতি আস্হা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।

নতুন একটি ঔষধ কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী হয়ে একদিন আবেদন নিয়ে হাজির হয় নোয়াখালী। ট্রেন থেকে নামার সময় ঘটে এক ভয়ানক কান্ড। টিউশনির দেড়শ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। সাথে পকেট কোনে আরো দুই টাকা। ত্রিশ টাকায় টিকেট কাটে। নোয়াখালী স্টেশনে গাড়ী থামার পর দেখে ফ্লাটফর্মের দিকের দরজাটা বন্ধ।বার কয়েক চেষ্টা করে খুলতে না পেরে পরের কামরা দিয়ে নামার জন্য পা বাড়ায়। যেই নামতে যাবে, মোবাইল কোর্টের লোকজন তাকে আটক করে। প্রথম শ্রেনীতে উঠার দায়ে ১২০ টাকা আদায় করে নেয়। হতভম্ব হয়ে স্টেশন ত্যাগ করে অনেক খোঁজাখুজি করে কাঙ্খিত ঠিকানায় গিয়ে দেখে তা বন্ধ। সেদিন রোজা শেষে দুই টাকার মুড়ি কিনে ইফতারী করে যখন বাড়ি ফিরে রাত অনেক হয়ে যায়।

একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। ফের আবেদন করে। অনেক দিন পার হয় ইন্টারভিউ কার্ড আসেনা। আসেনা তো আসেনা।এরি মাঝে আরেকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে। লোক মুখে শুনেছে এই চাকুরী পেতে হলে বড় অংকের টাকা দিতে হবে। টাকা দেয়ার সামর্থ্য তার বাবার নেই। তবু আশায় থাকে।

গ্রামের রাস্তায় বের হলে লোকজন নানা বিরক্তিকর মন্তব্য করে।"দেখ ছেলেটা কত লেখা পড়া করেছে,চাকুরী নাই;আরে এ দেশে মামা দুলাভাই না থাকলে কি আর চাকুরী মেলে? এখন ঘুর। না হালের হয়েছে না হয়েছে জোয়ালের। বাপটা খেটে মরছে উনি নবাবজাদা হয়ে ঘুরে বেড়ান।" এসব শুনতে আর ভাল লাগেনা তাই বাড়ি থেকে বের হওয়া অনেকটা বন্ধ করে দেয়।

একদিন পত্রিকার পাতায় একটি খরব দেখে চোখ আটকে যায় আমীর উদ্দিনের। একটি বেসরকারী ফাউন্ডেশন এইচ এস সি পাশ থেকে শুরু করে এম এ পাশ বেকারদের জন্য বিশেষ এক কর্মসূচী হাতে নিয়েছ। তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করার পাশাপাশি পড়াশোনাও করা যাবে। তাদের পলিসি দেখে আগ্রহী হয়ে আবেদন করে।

তিনটা ইন্টারভিউ কার্ড একসাথে আসে। বুধবার দিন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাতকার;বৃহস্পতিবার দীর্ঘদিন পূর্বে আবেদন করা প্রতিষ্ঠানের ইন্টারভিউ চট্টগামে আর শুক্রবারে অন্যটার পরীক্ষা কুমিল্লায়। নিজের টিউশনির কিছু টাকা এবং মায়ের কাছ থেকে কিছু নিয়ে রওয়ানা দেয়।
ঢাকায় সাক্ষাতকারের সময় ৪ টা এক ঘন্টা পূর্বেই সেখানে পৌছে। প্রতীক্ষার শেষ হয় সন্ধে সাতটায়। ফাউন্ডেশন প্রধান নাকি অন্য একটি মিটিংয়ে ছিলেন।আমীর উদ্দিনের সাক্ষাতকার শেষে তারা গ্রিন সিগনাল দিয়ে চলে যেতে বলেন। রাতের ট্রেনে চট্ট্রগ্রাম রওয়ানা দেয়।সারারাত না ঘুমিয়ে গাধাগাধি করে বসে থেকে সকালে পৌছে। অচেনা জায়গা চিনতে অনেক কষ্ট হয়। পকেটে অর্থের অভাবে পা দু’টোকেই বাহন বানিয়ে পথ খুঁজতে হয়। দুই ঘন্টা দেরিতে শুরু হওয়া পরীক্ষা শেষ হয় বিকেল ৪ টায়। ফেরত ট্রেন ধরতে হেঁটে পাহাড়তলী আসে। ট্রেন এখানে থামেনা শুনে আবার হেঁটে র্ওয়না দেয় বটতলী স্টেশনে।

রাত আটটায় একপ্রকার যুদ্ধকরে মেইল ট্রেনে উঠে। জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় এখানে।কিছু দালাল গোছের লোক আগেই ট্রেনে উঠে সিট দখল করে বসে আছে।যাত্রীদের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে। পুলিশও কম যায়না। তার ও টাকার বিনিময়ে একটি বগিতে লোক তুলছে। দুই দিনের কর্মক্লাতিতে ট্রেনে উঠার পরই ঘুমে চোখ বুঝে আসে। কিন্তু ঘুমাতে পারেনা যদি ট্রেন কুমিল্লা ছেড়ে চলে যায়। রাত একটায় ট্রেন থেকে নামে। চোখের পাশাপাশি শরীরেও ক্লান্তি ঝেঁকে বসে। একটি বিশ্রাম কক্ষে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুম দিতেই এক পুলিশ ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। বসার সিটটাও হারায়।

ভারসাসম্যহীন শরীরে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে রাতাটা কাটিয়ে সকালে বৃষ্টিতে কাকা ভেজা হয়ে এক স্কুলে হাজির হয়। তার মত হাজার হাজার চাকুরী প্রার্থী পূর্বেই এসে বসে আছে। মাত্র কয়েকটা পোস্টের জন্য এত প্রার্থী!কার হবে চাকুরী ভেবে পায়না। পরীক্ষা শেষে বাড়ী চলে আসে।

আমীর উদ্দিন মনে মনে আশাবাদী হয়ে উঠে,এবার নিশ্চয় একটা চাকুরী হবে। আশাটাকে একধাপ এগিয়ে দিতে সেই বেসরকারী ফাউন্ডেশন থেকে চিঠি আসে। সেখানে উল্লেখ আছে সে নিবর্বাচিত হয়েছে। সকল মূল সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে বলেছে তারা।

সেদিন শুক্রবার। সকালে কাঙ্খিত ঠিকানায় হাজির হয় ।পাঁচজন মানুষ তাকে নানা প্রশ্ন করে। শেষে তারা নিশ্চিত ভাবে জানায় সে নির্বাচিত হয়েছে। চাকুরী করবে পাশাপাশি এম বিএ পড়বে। বেতন হিসেবে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হবে। সেখান থেকে পড়াশোনার ফি হিসেবে আড়াইহাজার টাকা কেটে নেয়া হবে।দিনের প্রথম দিকে পড়াশোনা করবে বিকেলে করবে চাকুরী। আগামীকালই সে যোগদান করতে পারবে।এ জন্য তাকে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে।

টাকার কথা শুনে ব্যর্থ মনোরথে অফিস ত্যাগ করে।

একপশলা বৃষ্টি হয়।রাস্তা ঘাটেও পানি জমে।

পার্কের এক কোনে একটি বেঞ্চে বসে আমীর উদ্দিন। আজ বড় আশা নিয়ে এসেছিল। এখন আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। কেন লেখাপড়া করেছিল ভেবে পাচ্ছেনা। ছোট বেলায় বাবার সাথে কাজে লেগে গেলেই বরং ভাল হত। বাবার উপর ধকলটা কম পড়ত।নানা সব চিন্তা মাথায় ভর করে।
তার সামনে বেশ কিছু পানি জমে আছে।মৃদু বাতাসে পানিতে ছোট ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন ছোট্ট এক নদী। পানি দেখে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। বর্ষাকালে বৃষ্টির পর যখ তাদের উঠানে পানি জমত কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসাত।বৃষ্টির পানির স্রোতে নৌকাগুলো উঠানের এ মাথা থেকে ওই মাথায় ভেসে বেড়াত। সে স্মৃতি মাথা চারা দিয়ে উঠে। আমীর উদ্দিন হাতের ফাইলটা খুলে একটা করে সার্টিফিকেট বের করে আর একেকটা নৌকা তৈরি করে।একে একে সব গুলো পানিতে ভাসিয়ে দেয়।মৃদু বাতাসের পরশে নৌকাগুলো ধীর গতিতে দূরে চলে যেতে থাকে। আমীর উদ্দিন দেখতে পায় তার মনের জমাট বাধা কষ্টের পাহাড় নিয়ে নৌকা গুলো চলে যাচ্ছে।