ছবি

Posted by zhsoykot On মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫ 0 মন্তব্য(গুলি)

এক্সিবিশন শুরু হয়েছে সকাল নয়টায়। সন্মেলন কেন্দ্রে পাশ দিয়ে যাবার সময় ভাবনায় আসে একবার ঢু মেরে যাবার। তাই অরণ্যর আসা। প্রদর্শনী দেখে রীতিমত মুগ্ধ হয় । এত সুন্দর একটা প্রদর্শনী মিস হয়ে যেত ভেবে বেশ আফসোসই হচ্ছিল। তুঁলিঁর আচড়ে ফুটিয়ে তোলা থেকে শুরু করে পুরোনো সাদা কালো এমনকি হালের আধুনিক ক্যামেরার সাটার চেপে উঠানো আলোকচিত্র দিয়ে পুরু মিলনায়তন সাজানো হয়েছে। দর্শনাথীদের আনাগোনাও প্রচুর। কেউ কেউ কাছে গিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে ছবি। ছবি তোলা অরন্যর অন্যতম শখ। প্রদর্শনী কেন্দ্রে প্রবেশ করেই তার ক্যামেরা অন করে সাটার টিপতে শুরু করে। ছবি গুলো লেন্সের পর্দায় দেখে আর পছন্দ মত ক্যামেরায় তুলে নিতে থাকে। অরণ্যর ক্যামেরার সাটার কতক্ষণ পর পর এক একটা দৃশ্যকে ফ্রেম বানিয়ে তা বন্দী করতেই থাকে। এক সময় একটা দৃশ্যে চোখ আটকে যায়। সারি সারি গাছের পাতা ভেদ করে সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি শিশির কণার উপর পতিত হচ্ছে আর সেদিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে এক কিশোর। দৃশ্যটা তার কাছে জীবন্ত মনে হয় যেন ইচ্ছে করলেই তাকে ছোঁয়া যাবে। সেই জীবন্ত দৃশ্যটাকে ফ্রেমবন্দী করার জন্য ক্যামেরার সাটার টিপে। ছবিটা উঠে তবে আরেক জনের মুখাবয়ব সহ। সেই মুখ দেখে আরো বেশি চমকিত হয় অরণ্য। এবার ক্যামেরার আলোকবিন্দু সেই মুখের পানে নিবিষ্ট হয়। দর্শনার্থীর চোখ ছবিতে বিমুগ্ধ থাকায় পর পর কয়েকবার ক্যামেরা ক্লিক করলেও ঠিকমত ছবি তুলতে পারেনা। দুজন মুখোমুখি হয়। প্লিজ আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? অরন্যর বিনয়ী কথায় আর না করতে পারেননি । সাবলীল ভঙ্গিতে ছবি তোলায় সহায়তা করেন। বিভিন্ন এংগেল থেকে বেশ কয়টি ছবি তুলে নেয়। ছবি তোলার ফাকেঁ তিনি জানতে চান। আমাকে কি ছবি গুলো দেয়া যাবে? কেন নয়? আপনার ইমেল এড্রেস দিলে আমি পাঠিয়ে দিব। আমার কোন ইমেইল এড্রেস নেই। তাহলে আপনার ঠিকানা দিলে আমি নিজেই পৌছে দিয়ে আসব। আমার মোবাইল নম্বরটা রাখুন,পরে আপনার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিব না হয়। ঠিক আছে দেন। আচ্ছা ওই দিকটায় আর কয়েকটা ছবি তুলে দিবেন? তিনি মঞ্চের দিকে ইংগিত করেন। নম্বর দিতে দিতে অরণ্য আহ্বান করে চলুন….. ঠিক সেই মুহূর্তে অরণ্যর ফোনটা বেজে উঠে। রিসিভ করে কিছুই শুনতে পায়না। কথা শুনার সুবিধার্থে কোলাহল ছেড়ে একটু আড়ালে চলে আসে।বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তখনই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য এক বন্ধু অনুরোধ করে। কলটা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে চট জলদি আরো কয়টা ছবি তুলে বিদায় নেবার জন্য। সেখানে গিয়ে দর্শনাথীকে আর খুঁজে পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে অরণ্য ছবি গুলো এডিট করতে বসে।বেশ ভাল ছবি উঠেছে। বিশেষ করে একটি ছবি এতই সুন্দর উঠেছে যে সে চোখ ফেরাতে পারেনা। এমন মায়াবী টানা টানা চোখে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে সাধ্য কার! বেশ সময় নিয়ে নিখুঁত ভাবে ছবিটা এডিট করতে থাকে।যেভাবেই দেখে যে রঙে রাঙাতে চায় সে রঙেই অনবদ্য আকার ধারণ করে । ভাবনায় ও পড়ে। এত সুন্দর মানুষ হয় কি করে? সৃষ্টিকর্তা কি দুনিয়ার তাবৎ সৌন্দর্য তার মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন? হয়তোবা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে ছবির পানে। ছোট বোন চৈতির ডাকে তার সম্বিৎ ফিরে। কিরে এমন ধ্যানমগ্ন হয়ে কি দেখছিস? দেখি দেখি ছবিটা কাররে ভাইয়া? দেখতে তো বেশ। না কিছুনা। কিছুনা মানে আমিতো দেখছি তুই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছিস? কে মেয়েটি? চিনিনা। আজ এক্সিবিশন থেকে তুলেছি। চিনিসনা তাহলে ছবি তুললি যে? ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ সামনে পড়ে গেল। তা পরিচয় জানবিনা? সময় ছিলনা। তোর আর এ জীবনে সময় হবেনা। অরণ্য কিছুটা ক্ষেপে যায়। পাকামি বাদ দিয়ে বল কি জন্য এসেছিস? একটা মেইল করতে হবে। চৈতিকে পিসি দিয়ে অরণ্য উঠে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে অরণ্য ইমেইল চেক করার জন্য পিসি অন করতে গিয়েই চোখের পর্দায় বড় একটা ধাক্কা খায়। চৈতি ডেক্সটপের স্ক্রীনে সে ছবিটা সেট করে রেখেছে। এত সুন্দরভাবে ছবিটি ফুটে উঠেছে মনে হয় যেন কোন চিত্র শিল্পী বেশ যতন করে সৃষ্টি করেছে । চমৎকার স্লিম গড়ন,কাজল টানা দুটি চোখ,ডান পাশের ঠোটেঁর কোনে একটা তিলক চিহ্ন। ছবিট যেন অপূর্ব সৌন্দর্যের এক আধাঁর। এমনভাবে ছবিটি তোলা হয়েছে দেখলে মনে হয় পলকহীন তাকিয়ে আছে। প্রথমবার ছবি দর্শনের সাথে সাথে অরণ্য চোখাচোখির লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। দ্বিতীয়বার চোখ মেলার পর আর পলকই ফেলতে পারেনা।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ নয়নে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করেনা। ভার্সিটিতে যাবার সময় হয়ে যায় অরণ্যর খেয়ার থাকেনা। মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে। দ্রুত পিসি বন্ধ করে বাসা থেকে দৌড়ে বের হয়।ক্লাশে যেতে দশ মিনিট পেরিয়ে যায়।ক্লাশে বসে পাঠে মনযোগে ভাটা পড়ে। চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই ছবিটা। ইচ্ছে করলেও সেটা সরাতে পারেনা। ক্লাশ শেষে ল্যাবে যায় ছবি প্রিন্ট করার জন্য।সেখানে গিয়ে মনে পড়ে ছবিই নেয়া হয়নি। বিকেলে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরোলেও আড্ডায় মন বসেনা। অস্থিরতা কাজ করে মনে।কী যেন খুজেঁ বেড়ায়। আনমনা হয়ে যায় বারবার। বন্ধুরা প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যায়। কিছু সময় পর পর ছবির ভাবনা মনের কোনে ভিড় জমায়। আড্ডা শেষ হবার অনেক পূর্বেই অন্যদের ছেড়ে চলে আসে বাসায়। তখন ছবি আরো বেশি চুম্বকের মত টানে তাকে।পিসি খুলে এডিট করা ছবি গুলো ফের বিভিন্নভাবে নানা আকারে সাজায়। কত সময় ধরে এক একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছুটির দিনে অরণ্য অনেকটা সময় বাইরে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আজ আর ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছেনা।এ রোম থেকে ওই রোম;কখনো বিছনায় শুয়ে এবং এলোপাথাড়ি ভাবনার ঘোরেই দিনটা কাটিয়ে দেয়। শেষ বিকেল একবার ইচ্ছে জাগে ল্যাবে গিয়ে ছবি গুলো প্রিন্ট করিয়ে আনার কিন্তু কোন কিছুই হয়ে উঠেনা। ভার্সিটিতে যাবার সময় মনে করে পেনড্রাইভটা সঙ্গে করে নিয়ে নেয়। ছবি গুলো কেমন হল এক নজর দেখার জন্য মন আর সয়ছেনা যেন। এক ক্লাশ বাদ থাকতেই ল্যাবে গিয়ে উপস্থিত হয়। দেখে বিদ্যুৎ না থাকা ল্যাবের লোকজন খোশ গল্পে মত্ত। তিনদিন পর ছবি হাতে পায় অরণ্য। এবার অস্থিরতা আরো বাড়ে। একটা ফোনের অপেক্ষায় এ অস্থিরতা। কবে সে কাঙ্খিত মানুষটি ফোন দিবে। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতাশা করে সে ফোনের। কত সময় পর পর মোবাইলের দিকে তাকায়,কোন অপরিচিত নম্বর থেকে কল এল কিনা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অন্ধকার হাতড়ে মোবাইলটা খুজেঁ দেখে ফোন এল কিনা। রাত বিরাতে সময়ে অসময়ে ফোনটা বেজে উঠে। রিং শুরু হলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে। ছবির মানুষটি বুঝি ফোন দিল! প্রতিদিন অপ্রত্যাশিত অনেক ফোন এলেও অরণ্যর প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটেনা। চাতক পাখির ন্যায় সে একটা ফোনের অপক্ষোয় থাকে। নিজ থেকে ছবি চেয়ে ফোন নম্বর নেবার পরও কেন একবারও যোগাযোগ করেনি বিষয়টি বুঝে উঠেনা অরণ্য। তখন কেন তার নম্বরটা নেয়নি ভেবে প্রচন্ড রাগ হয়। এত অবশ্য তাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট। হুট করে কারোর সাথে মিশতে পারেনা। না হয় নিজের নম্বর দেয়ার পরিবর্তে তার নম্বরটা চেয়ে নিতে পারত। সময় যায় ;ফোন অসেনা। অরণ্য আশা ছাড়েনা।নিশ্চয় একদিন ঠিকানা পাবে ছবি গুলো পৌছে দেয়ার জন্য। শুধু ফোনের প্রত্যাশায় না থেকে চলতি পথে যদি কোথাও দেথা হয়ে যায় ভেবে ছবি গুলো নিজের সঙ্গেই রাখে। যখনই পিসি অন করে ডেক্সটপের ছবিটাসহ প্রতিটি ছবি বেশ সময় ধরে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখে। যতবার দেখে প্রতিবারই নতুনত্ব নিয়ে ফুটে উঠে ছবি গুলো। দেখে যেন তৃষ্ণা মেটেনা। কখনো কখনো প্রিন্ট করা ছবি গুলোও নাড়া চাড়া করে দেখে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষে একটা চাকুরী ও পেয়ে যায়।অফিস মতিঝিলে। মিরপুর থেকে মতিঝিল যেতে এবং আসতে প্রতিদিন অনেক নতুন মুখের দেখা মেলে। ভরসা পায় কোন একদিন সে মানুষটিরও দেখা পেয়ে যাবে। যে খানেই কোন প্রদর্শনীর খবর পায় ছুটে যায় অরণ্য। প্রদর্শনীর চেয়ে আগত দর্শনার্থীদের প্রতি নজর থাকে বেশি। অগনিত মানুষের ভীড়ে খুজেঁ ফিরে যাকে একদিন ক্যামেরাবন্দী করেছিল। বারবার হাতের স্পর্শে ছবি গুলো মলিন হয়ে যায়। নতুন করে প্রিন্ট করিয়ে নোর জন্য। সেখানে দেখা হয় এক বন্ধুর সাথে। জানতে চায় মেয়েটি কে? কয়দিন পূর্বে এক বন্ধু এক মেয়ের ঠিকানা দিয়েছিল একটা লিটলম্যাগ পাঠানোর জন্য। সে মেয়েটি কিনা জানতে চায়। অরণ্য জানায় যে ছবির মানুষটির সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। সপ্তাহে ছয় দিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত অফিস। যাওয়া আসার আরো ঘন্টা তিনেক।চক্রাকার বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায় অরণ্যর জীবন।শুধু ছুটির দিন গুলোতে খানিক বেড়ানোর সুযোগ মেলে। অন্যদিন গুলো কোন দিক দিয়ে চলে যায় খেয়ালই থাকেনা। এত ব্যস্ততার মধ্যে একজনার কথা মনে থাকে। কখনো কাজের ফাকেঁ, কখনো অবসর মুহূর্তে কিংবা প্রচন্ড ব্যস্ততার মাঝেও যে ছবিটি তার মনের কোনে ভেসে উঠে;যার কথা নিজের অজান্তেই মনে পড়ে সে..। প্রতিনিয়ত তাকে খুজেঁ ফেরে অরণ্য। ইউনিভার্সিটি থেকে বের হবার ঠিক এক বছরের মাথায় সমাবর্তনের আয়োজন করে কর্তৃপক্ষ। পড়ালেখা শেষ করে তার ক্লাশমেটদের অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। ঢাকা শহরে যারা থাকে ব্যস্ততায় তাদের সাথেও দেখা হয়ে উঠেনা। চলতি পথে রাস্তায় বা বাসের ভেতরে কোথাও দেখা হলে কৌশল বিনিময় করতে করতেই যে যার কাজে ছুটে চলে। সময় করে কয়েকজনে মিলে একত্রে বসা হয়ে উঠেনা। সবার অবসর সময় গুলো একত্রে ধরা দেয়না। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অনেক পরিচিত মুখ চোখে পড়ে অরণ্যর। দীর্ঘ দিন পরে একত্রে জড়ো হওয়ার আনন্দে অনেকেই বিভোর হয়ে পড়ে তুমুল আড্ডায়। কেউবা শেয়ার করে নিজ কর্মক্ষেত্রের কথা।কত হাসি-আনন্দ;দু:খ-বেদনার কথা মালা সেসব।মনযোগ সহকারে শুনে সবাই। প্রিয় শিক্ষকদের সাথেও দেখা হয়। তারা আগ্রহ ভরে জানতে চান কে কোথায় কি করছে। যখন শুনে চাকুরী করছে, ভাল অবস্থায় আছে তাদের মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠে। নানা উপদেশ দেন তাঁরা। কয় বন্ধুতে মিলে ক্যাম্পাসের এক পাশে গল্প করছিল অরণ্য। তার প্রিয় এক শিক্ষক পাশ দিয়ে চলার সময়ে ছুটে যায় তাঁর কাছে। অরণ্যকে দেখে তিনি খুব খুশি হন।কৌশল জানতে চান । কি করছে;কোথায় আছে সব জানতে চান।এক সময় তিনি তারঁ স্ত্রীর সাথে অরণ্যকে পরিচয় করিয়ে দেন। তোমাকে বলতামনা আমার একজন প্রিয় ছাত্র আছে যে খুব ভাল ছবি তুলে? এ হল সেই অরণ্য। আজ কয়েকটা ছবি তুলে নিও তাকে দিয়ে। আর অরণ্য এ হল আমার মানে তোমার ভাবী। মানুষটিকে দেখে অরণ্য বাকহীন মানুষের মত তাকিয় থাকে। এ যে সেই মানুষ যাকে সে খুজেঁ ফেরে।