ট্রেন ছাড়ার সময়ের আধঘন্টা পূর্বে স্টেশনে হাজির হই। প্লাটফরমে যাত্রী বলতে গেল নেই ই। মনে ভয় জাগে ট্রেন কি তবে চলে গেছে! মাঝে মাঝে মোবাইলে সময় উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। আজ কি তবে….। একজনার কাছে জানতে চাই সময় কত হলো। তার কথায় নিশ্চিত হলাম আমি আধঘন্টা আগেই এসেছি। কিন্তু স্টেশনে যাত্রী নেই কেন? ট্রেনও তো প্লাটফরমে দাড়িয়ে থাকার কথা। স্টেশনের অনুসন্ধান রোমের দরজা বন্ধ। সহকারী স্টেশন মাস্টার তার রোমে নেই। কিছু লোক সেখানে দাড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছেন। একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করেই চলছেন; কোনে উত্তর মেলেনা। সবাই বলাবলি করছে ট্রেন লেট, তবে কত সময় লেট কেউ জানেনা। রোমের দরজার পাশে দেয়ালে একটি কাগজ সাটানো আছে । সেখানে কয়েকটি ট্রেনের নম্বর ও একটি এসএমএস করার নম্বর দেয়া আছে ; ট্রেনের নাম লিখে মেসেজ পাঠালে ট্রেনের অবস্থান জানা যাবে। কয়েকজন চেষ্টা করে দেখছেন ট্রেনের অবস্থান জানার জন্য। আমিও কাঙ্ক্ষিত ট্রেনের অবস্থান জানার জন্য একটা মেসেজ পাঠাই। ফেরত মেসেজে জানানো হয় বিকেল ৩.১৫ সময় ট্রেন ছাড়তে পারে! মাত্র দশটা বাজে। বাসায় যেতে ১ ঘন্টা লাগবে। আবার ফিরতে একঘন্টা। মাঝে ৩ ঘন্টা সময় বিশ্রাম করে আসা যাবে। কিন্তু যেতে মন চাইছেনা। প্লাটফরমে এত সময় বসে থাকাও সম্ভব নয়। কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে ভালো হতো। হাতে বেশ নাদুশ নুদুশ একটা ব্যাগ। এটা নিয়ে হাঁটাও যাবেনা। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে পরিচিত একজনার বাসার দিকে রওয়ানা দিই। তার বাসায় যাবার পথে অন্য একজনার সাথে দেখা হয়। তাকে ব্যাগটা গছিয়ে অনির্ধারিত গন্তব্যে রওয়ানা দিই। যদি ট্রেন চলে যায় এই শংকায় তিনটার আগেই স্টেশনে পৌছে খবর নিয়ে জানতে পারি ট্রেন ডকে আছে। ফ্লাটফরমে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করি। আমার বসার স্থানের পাশেই পুলিশ ফাড়ি। দশ বারো বছরের একটি ছেলে সহ এক মহিলা এসে চারদিক সরগরম করে তুলেন। তিনি পাশের এক চায়ে দোকানে ব্যাগ ভুলে ফেলে এসেছিলেন। এখন দোকানদার ফেরত দিচ্ছে না। তার কথায় কয়েকজর পুলিশ সেই দোকোনের দিকে রওয়ানা হয়। একটু পরে পুলিশের লোকজন ফিরে আসে। খানিক বাদে মহিলাও আসেন। আবার শুরু করেন চেচামেচি! তার মতে দোকানদারের সাথে পুলিশ আতাত করে ব্যাগ মেরে দিয়েছেন! আর দোকানদারে ভাষ্য ব্যাগ দোকানে রাখেনননি, অন্য কোথাও….। তাই পুলিশের কিছু করার নেই। একজন পুলিশের সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমার এলাকার লোক। তার সাথে কথা বলতে বলতে ট্রেন এসে দাড়ায় সামনে। আমাকে সাথে করে নিয়ে চলেন সিট দেখিয়ে দেবার জন্য। ট্রেনের একেবারে সামনের বগিতে সিট। সিটের পাশে দাড়িয়ে নানা উপদেশ ও পরামর্শ্ দিতে থাকেন। আমি সুবোধ ছেলের মত গোগ্রাসে গিলতে থাকি সেসব। যাত্রীরা উঠতে শুরু করেছে ততক্ষণে। তিনজন যাত্রী সিট খুঁজতে খুঁজতে আমাদের সামনে এসে দাড়ায়। একজন বয়স্ক পুরুষের সাথে মহিলা এবং একটি মেয়ে। সাথে থাকা দুইটি বড় ব্যাগ উপরে রাখতে গেলে আমি এবং আমার সঙ্গী মিলে হেল্প করি। তাদের তিন সিটের ২ টি আমার বাম পাশে; অন্যটি আমার সাথে। বামপাশের জানালার পাশে বয়স্ক মহিলা বসেন। তার পাশে বসার জন্য বৃদ্ধ লোকটি মেয়েটিকে আদেশ করেন। সে জানায় জানালার পাশে বসবে এবং আমার সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ বাধা দিয়ে বলেন- কে…না… কে এখানে বসে…..। আমি জানাই ‘ বসুক কোন সমস্যা নেই, পাশের সিট আমার’। আমি পুলিশের সাথে নিচে নেমে যাই। ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময় পেয়ে যায় । ট্রেন ছাড়েনা। প্লাটফরমে অপেক্ষা করতে থাকি। একটা পত্রিকা কিনে ট্রেনে ফিরে আসি। দেখি মেয়েটি বাইরে জানালার পাশে দাড়ানো একটি ছেলের সাথে কথা বলছে। কারো দিকেই আমি তাকাইনা। ট্রেন কেন ছাড়ছেনা এই ভেবে বিরক্ত লাগে। আমার বিরক্তি বেড়েই চলে। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটায় ট্রেন ছাড়ে। আমি আমার সিটে এসে বসি। কিছুটা অস্বস্থিঃ অনুভব করি। আমার সিটের বাম পাশের হাতল নেই। ডান দিকে হেলান দিতে গেলে পাশের যাত্রীর গায়ে শরীর লেগে যায় ভয়ে পারিনা। স্বাভাবিক হতে পত্রিকায় চোখ বুলাই। পাতা মেলতে গিয়ে একবার দুই সিটের হাতলের উপরে রাখা পাশের যাত্রীর হাতের সাথে হাত লেগে যায়। উনি হাত নামিয়ে নেন। আমি পত্রিকার পাতায় মনোনিবেশ করি। (২) পত্রিকা পড়ায় সামান্য বিরতি দিই। পাশের যাত্রী মোবাইলে ব্যস্ত। হয়তো ফেসবুকে মশগুল। দুই হাত সমানে চলছে মোবাইলের স্ক্রীণে। এক হাতের কনুই ডান পাশের হাতলের উপর। আরেকটা হাত বামপাশের হাতলে রাখলে তার সুবিধে হয় কিন্তু হাতলটা দু‘জনের সিটের মাঝে হওয়ায় তার অর্ধেকটার (জার্নি শেষ না হওয়া পরযন্ত) মালিকানা দুইজনের এই ভেবে কদাচিত হাতলের উপর হাত বেখেয়ালে চলে এলেও সেটা আবার নামিয়ে নেন। কয়েকবার বিষয়টি আচঁ করতে পেরে আমি বলি- আপনি হাতলে হাত রাখুন, কোনো সমস্যা নেই। স্বতর্স্ফুর্ত ভাবে বা সৌজন্যাবোধ থেকে তাৎক্ষণিক জানতে চান- আপনার ওই পাশে হাতলটা নেই না? জ্বী, ভাঙ্গা। তাহলে আপনি এই হাতলে হাত রাখুন। আমার এপাশে একটা আছে। না আপনিই হাত রাখুন। আমার পাশে যেহেতু হাতল নেই মাঝেরটাও না ব্যববহার করি! গাড়ির গতি বেশ মন্তর। কত সময় পর পর ইচ্ছেমত যাত্রাবিরতি দিচ্ছে। দরজা জানালা সব বন্ধ থাকায় দিনের আলো শেষ হবার পূর্বেই আন্ধকার ঘনীভূত হয়। পত্রিকা পড়তে বেশ সমস্যা হয়। পাতা গুটিয়ে সামনের সিটের পেছনের খোঁপে গুঁজে রাখি। ট্রেনের লাইটগুলো জ্বলে উঠে। যাত্রীদের মুখগুলোও যেন উজ্জ্বল আভায় রাঙিন উঠে। আমি আবার পত্রিকা খুলে একটা কলাম পড়ায় মনযোগ দিই। আমার পাশের যাত্রী তার ব্যাগ থেকে একটা চিপসের প্যাকেট বের করে সেটার মুখ খুলে নিজে কয়েকটা নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে বলেন- নেন… ধন্যবাদ। আপনি খান ,আমি চিপস খাইনা। ও… ওজন বেড়ে যাবে এই ভয়ে চিপস খাবেবনা! (চিপস খেলে ওজন বাড়ে আপনার চেহারা দেখে সে কথার সপক্ষে প্রমাণ মেলেনা! মনে মনে বলি) না তা হবে কেন? আমি এমনিই খাইনা। আমার কাছে মনে হয় এটা ছোটদের খাবার। আচ্ছা নিচ্ছি বলে কয়েকটা চিপস হাতে নিই। পত্রিকাটা বন্ধ করে তার দিকে মনযোগী হই। ওহ.. আপনিতো বড় হয়ে গেছেন, আমি এখনো ছোট কিনা। আমি এবার তার মুখের দিকে তাকাই। মনে হলো স্রষ্টা দুনিয়ার তাবৎ সৌন্দর্য এক করে তার মাঝে দিয়ে দিয়েছেন! বয়স আন্দাজ করতে পারিনা। বলে নেয়া ভালো যখন বাইরে দাড়ানো ছেলেটির সাথে কথা বলছিল তখন মনে হচ্ছিল ভার্সিটি পড়ুয়া হবেন। এখন কিছুই অনুমান করতে পারছিনা। আপনার বাড়ি কি চিটাগাং? আবার চিপসের পেকেটটা বাড়িয়ে দিতে দিতে জানতে চান না। আমি একটা কাজে যাচ্ছি। সিলেটেই থাকেন বুঝি? জ্বী। তবে ঠিক শহরে না। একটু দূরে গোলাপগঞ্জ। আপনার বাড়ি কোথায়? অবশ্য বলতে চাইলে প্রয়োজন নেই। আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কাজের সূত্রে সিলেটে থাকি। আমার বাড়ি সিলেটেই। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি চিটাগাং চিপস খেতে খেতে জেনে নেন আমি কি করি, কেন চট্টগ্রাম যাচ্ছি , কতদিনবা থাকব ইত্যাদি ইত্যাদি। কুলাউড়া স্টেশনে গাড়ি থামার পরে আর ছাড়ার নাম নেই! বাস হলে এত সময়ে যাত্রীগন ড্রাইভারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে নিতেন। কেউ কেউ রেলওয়েল কর্তাগণের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। কেউ কেউ জানালা খুলে বাইরের দিকে দেখছেন। সন্ধের আবছা আধার নিকষ অন্ধারে বিলীন হবার পথে। (অসমাপ্ত)
1 মন্তব্য(গুলি):
এই ভ্রমণ বিষয়ক লেখাটি লেখার পর একজন পাঠক তেলে বেগুনে রেগে গিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল ভ্রমণ সহযাত্রীর সাথে আমার বেশ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাকে বোঝাতে পারিনি কেবল তিনি আমার সহযাত্রী ছিলেন। অনেক গালাগাল শুনে পরের পর্বটি সম্পূর্ণ কাল্পনিত ভাবে লিখেছি। পরের অংশ পড়ে সেই পাঠক ধরে নিয়েছিলেন আমি সহযাত্রীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি! কিন্তু তার ধারণা মোটেও সঠিক ছিলনা। আমি জীবনে অনেক পথ ভ্রমণ করেছি। অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। কারোর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন